রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১
জাতীয়প্রবাস বাংলাঅপরাধবাণিজ্যরাজনীতিসারাদেশমতামতস্বাস্থ্যরাজধানীপাঠকের কথাআবহাওয়াফিচারশিল্প-সাহিত্যগণমাধ্যমকৃষি ও প্রকৃতিইসলামবৌদ্ধহিন্দুখ্রিস্টানআইন-বিচারবিবিধআপন আলোয় উদ্ভাসিতবেসরকারি চাকুরিসরকারি চাকুরি Photo Video Archive

রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

হৃদয় ছোঁয়া এক ভ্রমণ

রহমান মৃধা|
  ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৩:১৪ | GMT +6

আমার ছোট ভাই, শাহীন মৃধা, লন্ডন প্রবাসী। তিনি সম্প্রতি স্বপরিবারে বাংলাদেশে বেড়াতে এসেছিলেন। ভ্রমণে আনন্দ যেমন থাকে, তেমনই বিষাদও থাকে। বিশেষ করে নিজ মাতৃভূমিতে ভ্রমণ সবসময় হৃদয়ে কোনো না কোনোভাবে দাগ কেটে যায়। এবারের ভ্রমণ শাহীনের বিবেকে একটু বেশিই নাড়া দিয়েছে, যদিও সে সবসময়ই বিবেকবান। দেশের বঞ্চিত এবং সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে থেকে, নানাভাবে তাদের জীবনের সুখ-দুঃখের অংশীদার হয়ে সে দূর প্রবাসে থেকেও কাজ করে যাচ্ছে।

এইবারের ভ্রমণটি তার দেখা শ্রেষ্ঠ ভ্রমণগুলোর একটি ছিল, কারণ সে ঢাকার রাস্তায় ৪-৫ আগস্ট গণভবন দখলের এক বীর সৈনিকের চেতনা নিয়ে উপস্থিত ছিল। ১৯৭১-এর যুদ্ধে শাহীন তখন খুবই ছোট ছিল। আমার মনে পড়ে, সেদিনের কথা যেদিন পাকবাহিনী আমাদের গ্রামের বাড়ি আক্রমণ করে। সবার হাতে অস্ত্র, শুধু নেই একজনের—সে ছিল পাক সেনা সদস্য। শাহীনকে বলতে শুনেছিলাম, ‘এই মিলিটারি, তোমার হাতে বন্দুক নেই কেন?’ সেদিন শাহীনের মনে কোনো ভয় ছিল না, কারণ সে এত ছোট যে ভয় কী জিনিস, তা তখনো সে শেখেনি।

৭১-এর সেই স্মৃতি নতুন করে মনে নিয়ে এবার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গণজাগরণের অংশীদার হয়ে নতুন বাংলাদেশ স্বাধীন হবার অনুভূতি অর্জন করতে পেরেছে, সরাসরি কাছ থেকে। বিলেতে ফিরে এসে সে আমাকে তার এই মধুময় ভ্রমণের বর্ণনা টেলিফোনে করে শোনায়। শাহীনের কথাগুলো আমার হৃদয় ছুঁয়ে গিয়েছিল। আমি তাকে বলেছিলাম, ‘লিখে পাঠাও, আমি এটা আমাদের পারিবারিক শেয়ার কর্নার থেকে শেয়ার করব অন্যদের জন্যও।’ এবার আসুন, জেনে নিই সে কী লিখেছে:

‘প্রতিবারই দেশ থেকে ফিরে এসে কোনো না কোনো ঘটনা মনে থেকে যায় অনেক দিন। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বিশেষ করে যখন হাসিনার শেষ ভাষণ দেবার ইচ্ছা পূরণ করতে দেওয়া হলো না, তার করুণ চেহারা- তার ভেতর যে অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছিল, তা ছিল দুর্দান্ত। লোভ লালসা মানুষকে কখনো কখনো যে এতটা অসহায় করে তোলে, তা হাসিনাকে না দেখলে দেশবাসী বুঝত না। হাসিনার কথা তুললাম উদাহরণ হিসেবে। এখন আসি আসল কথায়।

সেদিন ছিল শুক্রবার। পল্লীবিদ্যুৎ বাজারের পাশ দিয়ে আসতেই মাছ বিক্রেতা বললো, ‘ভাই, বড় সাইজের পদ্মার ইলিশ আছে, নিয়ে যান।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কত বড় সাইজের?’ সে বললো, ‘১ কেজি ২৩০ গ্রাম।’ পরে দেখা গেল, আসলে মাত্র একটা মাছ, সেটি অতি যত্ন করে কেটে দিলো। যাই হোক, পরিচিত মানুষ ভালোবেসে দিতে চেয়েছে বলে নিয়ে নিলাম। দাম পড়ল ২২০০ টাকার একটু বেশি। জুম্মার নামাজে যেতে হবে বলে শুধুমাত্র একটা মাছ নিয়েই রিকশায় এলাম। পথে তার সাথে কথার ফাঁকে জানতে পারলাম, লোকটা ১১ বছর ধরে ইলিশ মাছ কিনতে পারেনি। কী মনে হলো জানি না, রিকশা থেকে নামলাম এবং মাছটা রিকশাওয়ালা ভাইকে দিলাম। কিন্তু সে কিছুতেই নিতে রাজি হচ্ছিল না। মুহূর্তের মধ্যে ভাবলাম, ১১ বছর যে মানুষটা ইলিশ মাছ কিনতে পারেনি, তার জন্য পলিথিনে মোড়ানো ইলিশ মাছের টুকরাগুলো কীভাবে নিতে ইচ্ছে করছে না। সময়ের অভাবে একটু বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘দেখ ভাই, আমি খুশি হয়েই তোমাকে দিলাম, তুমি বাসায় নিয়ে খাও।’ শেষ পর্যন্ত তাকে রাজি করিয়ে মাছটি দিয়ে ঘরে ঢুকলাম গোসলের জন্য। 

গায়ে অর্ধেক পানি ঢালার পর কলিং বেলের শব্দ ভেসে এলো। কিছুটা বিরক্ত হয়ে গোসল সংক্ষেপ করে হেঁটে গিয়ে দেখি, লোকটি মাছ নিয়ে ফেরত এসেছে। আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘আবার কী হলো?’ সে যা বলল, তা শুনে সামান্য সময়ের জন্য ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলাম। লোকটা বলতে শুরু করল, ‘আমার বউ বলেছে, মাছটা আপনি খাবার জন্য কিনেছেন, সেটা নেওয়া ঠিক হয়নি। তুমি গিয়ে তাকে দিয়ে আসো এবং বলো যে আমার দুটো মেয়েকে যেন দুই পিস মাছ উনি দিয়ে দেন।’ কথাগুলো শুনে তার ওপর বিরক্ত না হয়ে কেমন যেন ভালো লাগা শুরু হলো। পরে তাকে আবার বুঝিয়ে মাছ দিয়ে ঘরে পাঠাই। 

তারপর শুরু হলো নিজের সাথে বোঝাপড়ার পালা। মসজিদে জুমার নামাজ পড়লাম এবং প্রতিবার সিজদায় গিয়ে নিজের জন্য দোয়া করতে লাগলাম, ‘আল্লাহ, তুমি আমাকে ঐ রিকশাওয়ালা ভাই এবং তার পরিবারের মতন নির্লোভ করে দাও।’ ওই দিন প্রতিবারই একই দোয়া করলাম নিজের জন্য। 

এখন আসি সার্বিক বিষয়ে—আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হওয়ার পরও লোভ সামলাতে পারেন না। বিশেষ করে হাসিনা, রেহেনা, জয়, টিউলিপ তারা গোটা দেশটাকে গিলে খাওয়ার পরও ক্ষুধা মিটছে না। দুর্নীতিবাজ সরকারি চাকরিজীবী এবং রাজনীতিবিদরা যখন ধরা পড়ে, তখন দেখা যায় তাদের স্ত্রীরাই অনেক সময় তাদের সকল অপকর্মে উৎসাহিত করেছেন। হানিফ সংকেত একবার বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে নারীরা স্বামী পরকীয়া করলে যেভাবে জ্বলে উঠে, তার দশ ভাগের এক ভাগ যদি ঘুস খেলে জ্বলে উঠত, তাহলে দেশে দুর্নীতি থাকত না।’ 

সেখানে একজন রিকশাওয়ালা ভাইয়ের স্ত্রী এবং তার বিবেচনাসহ নির্লোভ ভালোবাসা আমাকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কতটা নির্লোভ তা আমার মনে গভীর দাগ কেটে গেছে। অন্যদিকে, পলক, ওবায়দুল কাদের, বেনজীর, আজীজসহ সকল দুর্নীতিবাজ সচিব ও অন্যান্য সরকারি কর্মচারীরা, তাদের স্ত্রীসহ মিলে দেশটাকে গিলে খাচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সব অপকর্মে নারীদের দায় থাকলেও, এর যে ব্যতিক্রম হয় তা রিকশাওয়ালা ভাই এবং তার স্ত্রীর কাজ দেখলে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়। 

দেশ থেকে ফিরে আসার সময় জঙ্গী লীগ-এর অপকর্মের বেদনা, রিকশাওয়ালা ভাই এবং তার স্ত্রীর নির্লোভ মানসিকতা অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছে। পাশাপাশি নতুন করে স্বপ্ন দেখার ইচ্ছা জাগ্রত হয়েছে। বারবারই মনে হচ্ছে, দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মচারীদের পাশাপাশি হাজার হাজার সৎ ও নির্লোভ মানুষ আমাদের চারপাশে রয়েছে, তাদের নিয়ে সুন্দর বাংলাদেশ গড়া কোনো ব্যাপারই না।’

শাহীনকে অনেক ধন্যবাদ তার ব্যক্তিগত দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আমাদের সঙ্গে শেয়ার করার জন্য। তবে কেন যেন বার বার আমার মনে হচ্ছে - বাংলার সব মানুষের মধ্যে দেশপ্রেমের চেতনা এবং মানবতার জাগরণ এসেছে যা আমরা সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে সোনার বাংলা গড়তে পারব।

রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। 
[email protected]

এমআরএম

মন্তব্য করুন