মঙ্গলবার, ০৩ জুন ২০২৫, ২০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
জাতীয়প্রবাস বাংলাঅপরাধবাণিজ্যরাজনীতিঅন্যান্যসারাদেশমতামতস্বাস্থ্যফিচাররাজধানীপাঠকের কথাআবহাওয়াশিল্প-সাহিত্যগণমাধ্যমকৃষি ও প্রকৃতিইসলামবৌদ্ধহিন্দুখ্রিস্টানআইন-বিচারবিবিধআপন আলোয় উদ্ভাসিতবেসরকারি চাকুরিসরকারি চাকুরি Photo Video Archive

মঙ্গলবার, ০৩ জুন ২০২৫, ২০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

দুর্নীতি, দূষণ, দুঃস্বপ্ন—এই কি আজকের ঢাকা?

রহমান মৃধা|
  ২৬ মে ২০২৫, ১৩:০৪ | GMT +6

ঢাকা শহরকে কি আমরা আজ শুধুই একটি রাজধানী হিসেবে দেখি? নাকি এটি হয়ে উঠেছে এমন এক প্রতীকি স্থান, যেখানে দেশের সমস্ত ব্যর্থতা, কৃত্রিম উন্নয়ন আর রাজনৈতিক প্রহসনের প্রতিচ্ছবি জমা হয়েছে? প্রশ্নটা বড়, কিন্তু উত্তরটা হয়তো আমাদের চারপাশেই ছড়িয়ে আছে—ধোঁয়ায়, ধ্বংসে, দুর্ভোগে।

দুর্নীতিবাজ রাজনীতির রাজধানী—এই অভিধাটি ঢাকার গায়ে বেশ ভালোভাবেই মানিয়ে যায়। সংসদ ভবন থেকে শুরু করে সচিবালয়, মন্ত্রীর কার্যালয় থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর কেন্দ্রীয় অফিস—সবই এই শহরে। এখানে প্রতিদিন লাখো মানুষ মিছিল করে, ব্যানার ধরে, স্লোগানে মুখর করে তোলে রাজপথ। শহরের প্রতিটি মোড়, পার্ক, দেয়াল যেন রাজনীতির পোস্টারে আবৃত নাট্যমঞ্চ। কিন্তু এই রাজনীতি কতটা নাগরিকমুখী? কতটা দায়িত্বশীল? এর নেপথ্যে যারা আছেন, তাদের কতজন মানুষের পাশে দাঁড়াতে চান, আর কতজন শুধুই ক্ষমতার পালাবদলের খেলোয়াড়?

আজকের ঢাকা যেন এক বিশাল রাজনৈতিক কর্পোরেট অঞ্চল, যেখানে আন্দোলন আর রাজনীতি হয়ে উঠেছে বেকারদের কর্মসংস্থান। এমন লাখো বেকার প্রতিদিন ভাড়া খেটে অবরোধ করে, অবস্থান নেয়, রাস্তায় নামে। প্রশ্ন জাগে—এই বিপুল জনশক্তি যদি উন্নয়নমূলক কাজে লাগত, তাহলে ঢাকা কী আজ সত্যিই নর্দমায় রূপ নিত?

অথচ এই শহরের রাজপথেই প্রতিদিন মানুষ হাঁপিয়ে ওঠে যানজটে, ঘামে, ধুলায়, অনিশ্চয়তায়। প্রতিদিন ঘটে অগ্নিকাণ্ড, পানির সংকট, ভবন ধস। ফুটপাত দখল, খাল ভরাট, নদী গিলেছে বাণিজ্যিক আগ্রাসন। উন্নয়নের বুলি যতোই ছড়াক, বাস্তবে তা যেন কেবল গলাটিপে ধরার নামান্তর। গাছ কেটে রাস্তা করা হয়, অথচ সেই রাস্তায় প্রাণ নেই, ছায়া নেই।

এই শহরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গা—একটি সময় ছিল প্রাণের প্রতীক। আজ তা যেন বিষাক্ত স্রোত, ময়লার গহ্বর। কী অবস্থা বুড়িগঙ্গার? একটি চমৎকার নদীর তীরে গড়ে ওঠা শহর আজ তার শরীরে বিষ ঢেলে ধ্বংসের পথে এগিয়ে চলছে। কই, এই নদীর জন্য তো একবারও কেউ মিছিল করে না! ঢাকাকে ভালোবাসার দাবি যারা করেন, তাদের কেউই বুড়িগঙ্গার মৃত্যুর বিরুদ্ধে রাস্তায় নামেন না।

সবাই বলতে শিখেছে, “এই দেশ শেখ হাসিনার বাপের না”—কিন্তু ক’জন বলতে পারে, “এই দেশ দুর্নীতিবাজদের না”? ক’জন বলে, “এই দেশ ভাড়াটে রাজনৈতিক কর্মীদের না”? কেন আমরা রাষ্ট্রকে জবাবদিহির মুখোমুখি দাঁড় করাতে পারি না? এই মৌনতা কি কেবল ভয়, নাকি বিবেক হারিয়ে ফেলা এক জাতিগত ক্লান্তি?

ডেঙ্গুতে প্রতিবছর প্রাণ হারায় মানুষ। হাসপাতালের শয্যা কমে যায়, ওষুধ মেলে না, নাগরিকের কষ্ট চরমে ওঠে। কিন্তু সেই কষ্ট লাঘবে কেউ টুশব্দ করে না। অথচ কে মেয়র হতে পারলো না, সেই ইস্যুতে রাজপথে গর্জে ওঠে রাজনৈতিক জটলা। এটাই কি উন্নয়ন? এটাই কি বিবেক? লজ্জা কি দেশ থেকে বিদায় নিয়েছে? নাকি শব্দদূষণ আর দুর্নীতির চাপে বিবেকও আজ নিঃশেষ?

রাজউক, ডিএনসিসি, ডিএসসিসি, পরিবহন কর্তৃপক্ষ, নগর উন্নয়ন মন্ত্রণালয়—প্রতিষ্ঠানের অভাব নেই। প্রকল্পের সংখ্যাও হাজার ছুঁইছুঁই। কিন্তু কোথাও নেই একটুখানি সমন্বয়, স্বচ্ছতা বা মানবিক পরিকল্পনা। আছে শুধু কংক্রিট, প্রটোকল আর রাজনীতি নির্ভর কর্মসংস্থানের এক অভূতপূর্ব আয়োজন।
একসময় ঢাকায় যাওয়াটা ছিল গর্বের বিষয়—ভর্তি পরীক্ষা, চাকরির সন্ধান, আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে যাওয়ার আনন্দ। এখন ঢাকা মানে আতঙ্ক, যন্ত্রণা, অনিশ্চয়তা। এমনকি যারা ঢাকায় থাকে, তারাও এখান থেকে পালানোর পথ খোঁজে। অথচ প্রতিদিন লাখো মানুষ ঢাকায় আসে, কারণ গ্রামে বাঁচার মতো অবস্থা নেই। ফলে ঢাকা হয়ে উঠেছে একটি নিষ্ঠুর অভিবাসন-চুম্বক।

দ্বিজেন্দ্রলাল রায় একদিন লিখেছিলেন—
“পুষ্পে পুষ্পে ভরা শাখী; কুঞ্জে কুঞ্জে গাহে পাখি
গুঞ্জরিয়া আসে অলি পুঞ্জে পুঞ্জে ধেয়ে—
তারা ফুলের ওপর ঘুমিয়ে পড়ে ফুলের মধু খেয়ে।”
সে ছিল এক সময়ের কল্পলোক, এক আদর্শ বাংলার রূপকল্প—
কিন্তু আজ যদি তিনি ঢাকার দিকে তাকাতেন, তাহলে হয়তো লিখতেন—
“ধোঁয়ায় ঢাকা রোডের ফাটলে পুষ্প ঝরে পড়ে,
পাখি নয়, গন্ধে আসে মশা, উড়ে চলে ডেঙ্গুর ভয়ে—
অলির বদলে ভোঁ ভোঁ শব্দে ছুটে চলে দুর্নীতির গাড়ি,
আর মধুর বদলে গিলে ফেলে জীবন।”
তবুও, তবুও আমরা সেই বিশ্বাস ধরে রাখতে চাই,
“তবে আমি এখনও মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে চাই—
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,
সকল দেশের রানী সে যে—আমার জন্মভূমি।”

কিন্তু দুঃখের বিষয় আমরা এ শহরকে গড়ে তুলেছি প্রাণ ও প্রকৃতি ধ্বংস করে। নদী দখল করেছি, খাল ভরাট করেছি, গাছ কেটেছি, মাঠ কংক্রিটে ঢেকেছি। নিয়ম না মেনে বানানো ভবনগুলোতে প্রতিদিন ঘটে অগ্নিকাণ্ড। আমরা এগুলোকে বলি ‘দুর্ঘটনা’, অথচ এগুলো হলো রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড। সরকার আসে, যায়—কিন্তু সুশাসন আসে না। নীতির বদলে লটারি চলে, আর তাতে ভাগ্যবানরা ঢাকার উন্নয়নের নামে শুধু নিজেদের ভাগ্য গড়ে।

ঢাকায় মানুষের আগ্রহ কমছে, কিন্তু বিকল্প পথ নেই। গ্রামে শিক্ষিত মানুষের টিকে থাকার ব্যবস্থা করেনি রাষ্ট্র। শিক্ষকের, চিকিৎসকের, সাধারণ নাগরিকের জীবনযাপন যেখানে অসম্ভব, সেই গ্রাম আর নিরাপদ আশ্রয় থাকে না। ফলে ঢাকাই হয় শেষ আশ্রয়। কিন্তু এই আশ্রয়টাই হয়ে উঠেছে দুঃস্বপ্ন।

উন্নয়ন মানে যদি হয় শুধুই ভবন আর ব্রিজ, তাহলে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। কারণ আমরা উন্নয়নের নামে মানুষকে সরিয়ে দিচ্ছি, শ্বাসরুদ্ধ করে দিচ্ছি, পিষে ফেলছি হাজারো জীবন। যারা নীতিনির্ধারক, তারা বুঝেন না—শুধু বিল্ডিং নয়, একটি শহর গড়ে ওঠে ভালোবাসা, ন্যায়বিচার ও স্থিতিশীলতার উপর।

এই ঢাকা এখন আর রাজধানী নয়, এটি ব্যর্থতার এক নির্মম প্রদর্শনী। এখানেই এসে মেলে রাষ্ট্রের সংকীর্ণতা, দুর্নীতির বিস্তার, এবং অমানবিক শাসনের ছায়া।

ঢাকা একদিকে দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতির মঞ্চ, আর অন্যদিকে রাষ্ট্রচিন্তার অপমান। এই শহর দেখায় কীভাবে অন্ধ উন্নয়ন মানুষকে নিঃস্ব করে দেয়, আর কীভাবে রাজনীতিকে পেশা বানিয়ে রাষ্ট্রকে ভোগদখলের বস্তুতে পরিণত করা যায়। যতদিন না এই শহর থেকে শুরু হবে বিকেন্দ্রীকরণ, যতদিন না উন্নয়নের সংজ্ঞা হবে মানবিক, পরিকল্পিত ও বৈচিত্র্যপূর্ণ—ততদিন ঢাকা শুধু একটি শহর নয়, একটি অশ্রুপাতের নাম হয়ে থাকবে। একটি নীরব চিৎকার, যার অর্থ একটাই: রাষ্ট্র ভুল পথে হাঁটছে, এবং তার পদচিহ্নে পিষ্ট হচ্ছে মানুষের জীবন।

তাই এখনও সময় আছে। ঢাকার ভার হালকা করতে হলে শুধু নতুন প্রকল্প নয়, নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দরকার। গ্রামকে গড়তে হবে সম্মান নিয়ে বাঁচার উপযোগী করে। মানুষকে ফিরিয়ে দিতে হবে বিকল্প। অন্যথায়, এই ঢাকা একদিন আর কাউকে টানবে না—শুধু ধাক্কা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলবে বাঁচার শেষ আশা পর্যন্ত।

রহমান মৃধা
গবেষক এবং লেখক
সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
[email protected]

মন্তব্য করুন