দক্ষিণ আফ্রিকার যেসব নাগরিকের আদিপুরুষ ইউরোপ, বিশেষ করে নেদারল্যান্ডস থেকে এসে দেশটিতে বসতি স্থাপন করেছিলেন, তাদেরই আফ্রিকানার বলা হয়। এই আফ্রিকানরা কখনো ভাবতে পারেনি যে একদিন তারা নিজ দেশেই শরণার্থী হয়ে যাবে, আশ্রয় প্রার্থীর মতোই বিশ্বের কোনো দেশে নিরাপত্তার খোঁজে ছুটবে। অথচ গত শতাধিক বছর ধরে দক্ষিণ আফ্রিকায় তারা সংখ্যায় অল্প হলেও সম্পদে বিশাল।
পেছনে চোখ রাখলে দেখা যায়, কি এক দুঃশাসন আর শোষণে পিষ্ট ছিল আফ্রিকার এই কালো মানুষগুলো যুগ যুগ থেকে, শ্বেতাঙ্গ সংখ্যলঘুদের রক্তচক্ষুর কাছে। শোষণ নির্যাতন আর অমানবিক পাশবিকতা বৈধতা দিতে এরা চালু করেছিল আপার্থেইড নামের একটা নীতি কিংবা আইন। আপার্থেইড শব্দটির অর্থই হলো বর্ণের ভিত্তিতে পৃথকীকরণ, যা কার্যত কালো মানুষদের অধিকারকে খর্ব করে এবং শ্বেতাঙ্গদের জন্য বিশেষ সুবিধা নিশ্চিত করে। এই আইন দিয়ে ১৯৪৮ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত তার অমানবিক নির্যাতন চালিয়েছে, শোষে নিয়েছে রক্ত । তাদের ক্ষমতা দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষ্ণাঙ্গ এবং অন্য বর্ণের গোষ্ঠীগুলোর ওপর নির্মম প্রভাব ফেলে ক্রমেই প্রতিপত্তিশালিনী হয়ে উঠেছিলো সংখ্যালঘিষ্ঠ শ্বেতাঙ্গরা, বংশ পরম্পরায়, এমনকি শত বছর পেরিয়েও।
আপার্থেইডের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো ছিল: ১. বর্ণগত শ্রেণিবিভাগ—মানুষকে শ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ, ভারতীয় এবং রঙিন (মিশ্র বর্ণের) হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হতো। ২. ভৌগোলিক পৃথকীকরণ—বিভিন্ন বর্ণের জনগোষ্ঠীগুলোকে পৃথক এলাকায় বসবাস করতে বাধ্য করা হতো। ৩. মৌলিক অধিকার খর্ব—অশ্বেতাঙ্গদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অধিকার সীমিত ছিল। ৪. বর্ণবৈষম্যের প্রচার—বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে বিয়ে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবৈষম্য নীতির (আপার্থেইড) অধীনে শ্বেতাঙ্গ দক্ষিণ আফ্রিকানরা বিশাল কৃষিজমির মালিকানাসহ উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা ভোগ করত। এ নিয়ে যুগের পর যুগ সংগ্রাম করেছে আফ্রিকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষগুলো। অবশেষে ১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় আপার্থেইডের অবসান ঘটে। আপার্থেইডে পরবর্তীসময়ে ঐতিহাসিক অবিচার দূর করতে ভূমি পুনর্বাসন এবং পুনর্বণ্টনের মতো উদ্যোগ নেওয়া হয়। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, এই প্রচেষ্টার পরও, দেখা যায় দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যক্তিগত কৃষিজমির প্রায় ৭২ শতাংশ শ্বেতাঙ্গ কৃষকদের হাতে থেকে যায়, যদিও তারা দেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৯ শতাংশ।
নেলসন ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকার সংখ্যাগরিষ্ঠ কালো মানুষরা স্বাধীনতা অর্জন করে এবং একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাভাবিকভাবেই শ্বেতাঙ্গ আফ্রিকানদের জন্য পরিস্থিতি বদলে যেতে থাকে। তারা ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক প্রভাব ও জমির মালিকানা হারাতে থাকে। সরকারের ভূমি পুনর্বাসন এবং পুনর্বণ্টন নীতির ফলে তাদের জমি অধিগ্রহণের মুখে পড়তে হয়।
এই প্রক্রিয়া কেবল দক্ষিণ আফ্রিকায়ই নয়, অন্যান্য আফ্রিকান দেশেও দেখা যায়। জিম্বাবুয়ের শ্বেতাঙ্গ কৃষকদেরও একই ধরনের ভূমি পুনর্বণ্টন নীতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল, যেখানে ১৯৮০ সালে মুগাবের নেতৃত্বে শ্বেতাঙ্গ প্রভাব কমতে শুরু করে। ২০১৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় সংবিধান সংশোধন করে ক্ষতিপূরণ ছাড়াই জমি অধিগ্রহণের নীতি গ্রহণ করা হয়, যা শ্বেতাঙ্গ আফ্রিকানারদের মধ্যে আতঙ্কের সঞ্চার করে।
এ প্রস্তাবের সমর্থকরা বলছেন, এটি ঐতিহাসিক জমি দখলের সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয়, অন্যদিকে সমালোচকরা আশঙ্কা করছেন যে এটি সম্পত্তির অধিকার এবং কৃষি উৎপাদনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ২০২৪ সালে ‘এক্সপ্রোপ্রিয়েশন অ্যাক্ট’ পাস হয়, যা সরকারকে নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে ক্ষতিপূরণ ছাড়াই জমি দখলের ক্ষমতা দেয়। ফলে শ্বেতাঙ্গ কৃষকদের মধ্যে তাদের সম্পত্তি ও জীবিকা হারানোর ভয় বেড়ে যায়।
গত কয়েক বছর থেকে দেশটিতে বিশাল জমি নিয়ে চাষ করা কিংবা বাণিজ্য করা শ্বেতাঙ্গ জমিদারদের খামারে আক্রমণ অব্যাহত আছে এবং এই আক্রমণ একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছু প্রতিবেদন বলছে, শ্বেতাঙ্গ কৃষকরা এখানে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। আরও পেছনে ২০০৩ সালের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, খামার আক্রমণের ৬১ শতাংশ শিকার শ্বেতাঙ্গ এবং ৩৩ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গও ছিলেন। যদিও ২০০৭ সালের পর দক্ষিণ আফ্রিকার পুলিশ বিস্তারিত খামার হত্যার পরিসংখ্যান প্রকাশ বন্ধ করে দিয়েছে, যা বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণকে জটিল করে তোলে।
বর্তমানে আফ্রিকানদের মধ্যে কেউ কেউ নিজেদের শরণার্থী হিসেবে অন্য দেশে আশ্রয়ের চেষ্টা করছেন। আফ্রিফোরামের (AfriForum) মতো সংস্থাগুলো অভিযোগ করছে, শ্বেতাঙ্গ কৃষকরা বিশেষভাবে লক্ষ্যবস্তু হচ্ছেন এবং তাদের ওপর সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে, সরকার এই ঘটনাগুলো সাধারণ অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করছে। সব মিলিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ জমিদাররা ভালো নেই । এরা এখন যেমন জমি হারাচ্ছেন প্রতিনিয়ত, ঠিক সেভাবেই তাদের জীবনও হয়তো ঝুঁকিতে ।
আফ্রিকার সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গরা, যারা তাদের ক্ষমতার দাপটে শতাধিক বছর মানুষের জীবন-যৌবন-আবেগ-অনুভূতি তথা বাঁচার অধিকারকে পশুর অধিকারের চেয়ে নিকৃষ্টভাবে দেখেছে । কিন্তু ইতিহাসের অমোঘ অনিবার্যতায় আজ হেরে যাচ্ছে তারা । শত বছরের শোষণ-নির্যাতনের প্রাকৃতিক প্রতিশোধ যেন তাদের দিকেই ছুটে যাচ্ছে এখন ধীরে ধীরে---হারাচ্ছে বৈভব, নিঃস্ব হচ্ছে। দুঃখজনকভাবে তাদের ও কারও কারও এখন হচ্ছে দুঃখজনক পরিণতি, অমানবিকভাবেও তারাও এখন পৃথিবীর কাছে সহায়তাপ্রার্থী ।
পশ্চিমা বিশ্ব, যারা একসময় আফ্রিকায় শোষণকে সমর্থন করেছে, আজ সেই আফ্রিকানদের শরণার্থীর মর্যাদা দিচ্ছে একসময় যারা অন্যের স্বাধীনতা হরণ করেছিল, আজ তারাই জীবনের নিরাপত্তার জন্য ছুটছে। ইতিহাসের চক্র যেন তাদের সামনে নির্মম প্রতিশোধের মতো ফিরে এসেছে।
অবাক করা বিষয় হলো, পশ্চিমা বিশ্ব যারা শতাব্দী ধরে আফ্রিকান জনগণের দুঃখ-দুর্দশা উপেক্ষা করেছে, আজ তারাই শ্বেতাঙ্গ আফ্রিকান শরণার্থীদের রক্ষায় উদ্বিগ্ন। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ৫৯ জন শ্বেতাঙ্গ আফ্রিকানদের শরণার্থী হিসেবে স্বাগত জানানোর ঘটনা যেন বর্ণবৈষম্যকেই প্রশ্রয় দেয়। আফগানিস্তান, সিরিয়া, ফিলিস্তিনের শরণার্থীদের প্রতি তাদের করুণার ছিটেফোঁটাও যেখানে নেই, সেখানে শ্বেতাঙ্গ আফ্রিকানদের আশ্রয় দেওয়ার প্রতিশ্রুতি কি বর্ণবাদের এক নতুন অধ্যায় নয়?
ইতিহাস প্রতিশোধ নেয়। দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গরা আজ সেই প্রতিশোধের শিকার, যারা যুগের পর যুগ নিপীড়ন করেছে, শোষণ করেছে, কিন্তু আজ নিজেরাই বাঁচার জন্য হাত পেতে দাঁড়িয়েছে... এটা ইতিহাসেরই এক নির্মম এবং কঠোর পরিহাস।
লেখক: ব্রিটেন প্রবাসী কলামিস্ট।
মন্তব্য করুন