শনিবার, ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২
জাতীয়প্রবাস বাংলাঅপরাধবাণিজ্যরাজনীতিঅন্যান্যসারাদেশমতামতস্বাস্থ্যফিচাররাজধানীপাঠকের কথাআবহাওয়াশিল্প-সাহিত্যগণমাধ্যমকৃষি ও প্রকৃতিইসলামবৌদ্ধহিন্দুখ্রিস্টানআইন-বিচারবিবিধআপন আলোয় উদ্ভাসিতবেসরকারি চাকুরিসরকারি চাকুরি Photo Video Archive

শনিবার, ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২

বিশ্বে মাইক্রোফোন যুদ্ধ চলছে

ফারুক যোশী, প্রবাসী সাংবাদিক
  ১৮ জুন ২০২৫, ১৮:২৭

গত কয়েক সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও প্রযুক্তি ধনকুবের ইলন মাস্ক এর মধ্যে প্রকাশ্য বাগ্যুদ্ধ বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তুলেছে। এই সংঘাত কেবল দুই ব্যক্তির ব্যক্তিগত মতবিরোধে সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং এতে ফুটে উঠেছে আধুনিক গণতন্ত্রে ব্যক্তিমালিকানাধীন কর্পোরেট শক্তি ও রাজনৈতিক ক্ষমতার এক জটিল ও উদ্বেগজনক সংমিশ্রণ।

মার্কিন রাজনীতিতে ট্রাম্পের অবস্থান যেমন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে, তেমনি মাস্কের মালিকানাধীন টেসলা, স্পেসএক্স ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম X (সাবেক টুইটার) তাকে দিয়েছে বিস্তৃত সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব। এমন দুই ব্যক্তি যখন মুখোমুখি হন, তখন সেটি কেবল ব্যক্তি পর্যায়ের বিবাদ নয়—বরং রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণ থেকে শুরু করে বাজার ব্যবস্থা ও জনমতের ওপরও প্রভাব বিস্তার করে।

এই বিরোধের সূচনা ঘটে যখন মাস্ক হোয়াইট হাউসের একটি পরামর্শদাতা কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন এবং ট্রাম্পের ট্যাক্স পরিকল্পনাকে “অসাধারণ রকমের অযোগ্য” বলে অভিহিত করেন। ট্রাম্পও পাল্টা জবাবে মাস্ককে লক্ষ্য করে তার Truth Social প্ল্যাটফর্মে একাধিক বার্তা ছুড়ে দেন। যদিও ২০২৪ সালের নির্বাচনে মাস্ক ট্রাম্পকে ২৫০ মিলিয়ন ডলার অনুদান দেন বলে গণমাধ্যমে প্রচার রয়েছে, তবে সেই সম্পর্কের নাটকীয় অবনমনকে অনেকেই আমেরিকার রাজনীতির “নতুন বাস্তবতা” হিসেবে চিহ্নিত করছেন।

মিডিয়ায় এই দ্বন্দ্বকে “বিশ্বের সবচেয়ে বড় মাইক্রোফোন যুদ্ধ” বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে—যেখানে দুই পক্ষই তাদের নিজস্ব প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে একে অপরকে আক্রমণ করেছেন। ট্রাম্প যেখানে তার অনুসারীদের সঙ্গে যোগাযোগে Truth Social ব্যবহার করছেন, সেখানে মাস্কের মালিকানাধীন X পরিণত হয়েছে রাজনৈতিক প্রচার ও জনমত প্রভাবিত করার এক বিশাল পরিসরে।

ট্রাম্প প্রকাশ্যে হুমকি দিয়েছেন, তিনি মাস্কের প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্সের সরকারি বরাদ্দ ও চুক্তি বাতিল করে দেবেন। এই হুমকির প্রতিক্রিয়ায় মাস্ক হুঁশিয়ারি দেন, আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত তার গুরুত্বপূর্ণ যান ‘ড্রাগন’ সরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করবেন। যদিও পরে তিনি সেই অবস্থান থেকে সরে আসেন, তবে এতেই বোঝা যায় যে, কর্পোরেট ও রাজনৈতিক শক্তির এই সংঘাত কোনো একক দেশের সীমায় সীমাবদ্ধ নয়—বরং এর অভিঘাত বিশ্বব্যবস্থায়ও অনুরণন তোলে।

বিশ্লেষকদের মতে, এই লড়াই কেবল রাজনৈতিক কিংবা কর্পোরেট বিবাদ নয়—এটি বর্তমান সময়ের একটি গভীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের প্রতিচ্ছবি। যখন একজন রাজনীতিবিদ তার ব্যক্তিগত বিরোধ মেটাতে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করতে চান, তখন সেটা শুধু অনৈতিক নয়, বরং গণতান্ত্রিক কাঠামোর ওপর সরাসরি আঘাত। একইভাবে, যখন একজন প্রযুক্তি উদ্যোক্তা রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার জন্য তার কর্পোরেট ক্ষমতা ব্যবহার করেন, তখন তা রাষ্ট্র ও কর্পোরেট জগতের সীমারেখা মুছে ফেলে।

এই সংঘাতের আরেকটি আলোচিত দিক হলো মাস্কের একটা দাবি—যেখানে তিনি বলেন, ট্রাম্পের নাম মৃত যৌন অপরাধী জেফরি এপস্টাইনের সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু গোপন নথিতে রয়েছে। যদিও এই দাবি এখনও প্রমাণিত হয়নি, তবুও এটা প্রমাণ করে, মাস্ক শুধু প্রযুক্তি নিয়েই ব্যস্ত নন; বরং রাজনৈতিক আঘাত হানার মত প্রভাবও রাখেন।

এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠতেই পারে—এই দুই ব্যক্তি আসলে কি জনস্বার্থে কাজ করছেন, না কি ব্যক্তি ও শ্রেণিস্বার্থ তাদের চালিকা শক্তি? আধুনিক গণতন্ত্র কি সত্যিই এখন জনসম্পৃক্ত, না কি এটি এক ধরণের কর্পোরেট-রাজনৈতিক চুক্তিতে পর্যবসিত হয়েছে?

বিশ্ব আজ যেটা দেখছে, তা সম্ভবত একটি নতুন বাস্তবতা—যেখানে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরেই ব্যক্তি বিশেষের আধিপত্য বিরাজ করছে। রাষ্ট্র, বাজার এবং জনমত যখন একইসঙ্গে দুই প্রভাবশালী ব্যক্তির কণ্ঠে বন্দি হয়ে পড়ে, তখন সুশাসনের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও নৈতিকতা বিপন্ন হয়। এই ‘মেগাফোন যুদ্ধে’ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। আমেরিকার নাগরিক বলি আর পৃথিবীর সাধারণ মানুষদের দৃষ্টিভঙ্গি যদি আমরা বিবেচনায় নেই, তাহলে দেখা যাবে এতে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ ও ব্যক্তি স্বার্থের পার্থক্য নির্ণয় করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে ।

তবে বাগ্যুদ্ধ নাটকীয় মোড় নেয় তখনই, যখন মাস্ক তাঁর এক্সে (x ) লেখেন—তিনি তার আগের কিছু পোস্ট নিয়ে অনুতপ্ত। অন্যদিকে, নিউ ইয়র্ক পোস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প জানান, তিনি পুনর্মিলনের সম্ভাবনার ব্যাপারে উন্মুক্ত এবং এই বিরোধ নিয়ে তিনি ‘হতাশ’, তবে মনে কোনো ‘ক্ষোভ’ নেই।

দুই মহাশক্তির এই আচমকা সুর নরম হয়ে আসা যেন আরও একটি বার্তা দেয়—এদের দ্বন্দ্ব যেমন দ্রুত তৈরি হয়, তেমনি শ্রেণিগত স্বার্থ সুরক্ষার প্রয়োজন হলে সেটি দ্রুত মিলিয়েও যায়। বাস্তবতা হলো, এই শ্রেণির অবস্থান একই সমতলে; ক্ষমতা ও প্রভাবের যে উচ্চতায় তারা অবস্থান করেন, সেই জায়গা থেকে তারা সরে আসবেন কেন? বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ যখন ফসকে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি করে, তখনই তাদের দ্বন্দ্ব পেছনে পড়ে থাকে এবং শ্রেণিস্বার্থই মুখ্য হয়ে ওঠে।

লেখক : ব্রিটেন প্রবাসী কলামিস্ট।

মন্তব্য করুন