শুক্রবার, ১৩ জুন ২০২৫, ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
জাতীয়প্রবাস বাংলাঅপরাধবাণিজ্যরাজনীতিঅন্যান্যসারাদেশমতামতস্বাস্থ্যফিচাররাজধানীপাঠকের কথাআবহাওয়াশিল্প-সাহিত্যগণমাধ্যমকৃষি ও প্রকৃতিইসলামবৌদ্ধহিন্দুখ্রিস্টানআইন-বিচারবিবিধআপন আলোয় উদ্ভাসিতবেসরকারি চাকুরিসরকারি চাকুরি Photo Video Archive

শুক্রবার, ১৩ জুন ২০২৫, ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাবে বই পড়ুয়ার অকাল মৃত্যু

সাদিয়া সুলতানা রিমি
  ১১ জুন ২০২৫, ১৪:৫৬

একসময় বই ছিল জ্ঞানের এক অফুরন্ত উৎস, অবসর কাটানোর শ্রেষ্ঠ সঙ্গী এবং মননশীলতার পরিচায়ক। লাইব্রেরিগুলো ছিল পাঠকের পদচারণায় মুখর, প্রতিটি নতুন বইয়ের প্রকাশনা ঘিরে তৈরি হতো এক অন্যরকম উন্মাদনা। চায়ের আড্ডা, কফি হাউসের কোণায় চলতো নতুন বইয়ের চুলচেরা বিশ্লেষণ, চরিত্রের মনস্তত্ত্ব নিয়ে গভীর আলোচনা। পাঠক মানেই ছিল এক অনুসন্ধিৎসু মন, যে শব্দে, বাক্যে, এবং গল্পের ভাঁজে খুঁজে ফিরতো জীবনের নতুন অর্থ। 

কিন্তু ডিজিটাল বিপ্লবের সেই উত্তাল ঢেউয়ে সবকিছুই যেন বদলে গেছে। স্মার্টফোন, ট্যাবলেট আর ল্যাপটপের ঝলমলে স্ক্রিনে আজ বিনোদন ও তথ্যের এক সুবিশাল ভাণ্ডার উপচে পড়ছে। আর এর ভিড়ে, ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে সেই চিরচেনা "পাঠক"। আমরা কি তাহলে ডিজিটাল যুগে পাঠকের এক অকাল প্রয়াণ দেখছি, নাকি এটি কেবলই একটি রূপান্তর, যার ফলস্বরূপ পাঠকের সংজ্ঞাটাই বদলে যাচ্ছে?

আজকের প্রজন্মের হাতে হাতে ঘুরছে স্মার্টফোন; যেন শরীরেরই এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব, টিকটক– বিনোদনের হাজারো উপাদান মুহূর্তে হাতের মুঠোয়। একটি দীর্ঘ আর্টিকেল বা একটি বই পড়ার ধৈর্য কোথায়? স্ক্রল করতে করতেই পেরিয়ে যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা, চোখের সামনে ভেসে ওঠে অসংখ্য ছবি, ভিডিও, আর ক্ষণস্থায়ী পোস্ট। কিন্তু বইয়ের পাতায় চোখ রাখতে যেন মন চায় না। 

সোশ্যাল মিডিয়ার চটজলদি উত্তেজনা আর ভিডিওর দৃশ্যায়ন পাঠকদের আকর্ষণ কেড়ে নিচ্ছে বইয়ের ধীরগতির, গভীর পঠন প্রক্রিয়া থেকে। এই যে "ইনস্ট্যান্ট গ্র্যাটিফিকেশন"-এর আকাঙ্ক্ষা, যেখানে সবকিছু তাৎক্ষণিকভাবে পেতে চাওয়া হয়, তা পাঠকের মনোযোগের ব্যাপ্তি (attention span) কমিয়ে দিচ্ছে ভয়াবহভাবে। একটি দীর্ঘ অনুচ্ছেদ পড়তে গেলেই মনে হয় সময় নষ্ট হচ্ছে, যেখানে একটি ছোট ভিডিও বা মিম মুহূর্তেই আনন্দ দিতে পারে। এভাবেই অজান্তেই আমরা সেই গভীর পঠন অভ্যাস থেকে দূরে সরে যাচ্ছি, যা পাঠক হওয়ার মূল ভিত্তি।

ডিজিটাল মাধ্যম তথ্যের এক বিশাল সমুদ্র, যা সব ধরনের তথ্যকে আমাদের হাতের নাগালে নিয়ে এসেছে। যখন যা দরকার, গুগলে একটি মাত্র সার্চ করলেই মুহূর্তেই হাজির হয় হাজারো ওয়েবপেজ, আর্টিকেল, ব্লগপোস্ট। মনে হতে পারে, এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে? কিন্তু এই তথ্যের ভিড়ে জ্ঞানের গভীরতা কতটুকু? একটি বই যেখানে একটি বিষয়কে বিশদভাবে তুলে ধরে, বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করে, লেখকের নিজস্ব দর্শন ও গবেষণার ছাপ থাকে, সেখানে অনলাইন আর্টিকেলেরা প্রায়শই উপরি উপরি তথ্য দেয়, যা একটি নির্দিষ্ট প্রশ্নের তাৎক্ষণিক উত্তর দিতে সক্ষম হলেও সামগ্রিক ধারণা দিতে ব্যর্থ হয়। পাঠক হয়তো অনেক কিছু সম্পর্কে অল্প অল্প জানতে পারছে, কিন্তু কোনো একটি বিষয়ে গভীর জ্ঞান অর্জন বা সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করার সুযোগ কমছে। এটাই সম্ভবত "প্রচুর তথ্য, কম জ্ঞান"-এর এক নতুন সংজ্ঞা। তথ্যের সহজলভ্যতা যেখানে জ্ঞান অর্জনের পথ খুলে দিতে পারত, সেখানে তা পরিণত হচ্ছে একটি অগভীর স্রোতে, যেখানে পাঠক ভেসে যাচ্ছে, কিন্তু গভীরে ডুব দিতে পারছে না।

বইয়ের দোকান থেকে ই-বুকের পাতায়, তারপরও কি পাঠক টিকে আছে? একসময় নতুন বইয়ের গন্ধে ম ম করত বইয়ের দোকানগুলো। সেখানে দল বেঁধে যেত পাঠক, নতুন বইয়ের খোঁজে, লেখকের সাথে দেখা করার আশায়। এখন সেই চিত্র অনেকটাই পাল্টে গেছে। ই-বুক এবং অডিওবুকের সহজলভ্যতা হয়তো কাগজের বইয়ের আবেদন কিছুটা কমিয়েছে, তবে সেটিকেও কি শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারছে পাঠককে? ডিজিটাল মাধ্যমে বই পড়ার সুযোগ থাকলেও, পাঠকের মনোযোগের ব্যাপ্তি কমে যাওয়ায় ই-বুকও হয়তো সেই অর্থে পাঠকের সংখ্যা বাড়াতে পারছে না, বরং এক ধরনের "ফরম্যাট পরিবর্তন" ঘটছে মাত্র। যারা একসময় বই পড়ত, তারা হয়তো এখন ই-বুক পড়ছে। কিন্তু যারা নতুন করে পাঠক হিসেবে গড়ে ওঠার কথা, তারা অন্য বিনোদনের মাধ্যমগুলোতে বেশি আকৃষ্ট হচ্ছে। ফলে, ঐতিহ্যবাহী পাঠকের সংখ্যা কমছে, এবং নতুন পাঠক তৈরি হচ্ছে না আশানুরূপভাবে।

পাঠকের এই অকাল প্রয়াতের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব
পাঠকের এই বিলুপ্তি বা অন্তত সংখ্যা হ্রাস কেবল একটি বিনোদন মাধ্যমের পরিবর্তন নয়, এর গভীর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব রয়েছে। পাঠকহীন সমাজ মানে এমন এক সমাজ যেখানে সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার অভাব দেখা দিতে পারে। বই পড়া কেবল তথ্য গ্রহণ করা নয়, এটি মনকে প্রশিক্ষিত করে ভাবতে শেখায়, প্রশ্ন করতে শেখায়, ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়কে দেখতে শেখায়। যখন এই অভ্যাসের বিলুপ্তি ঘটে, তখন সমাজ সহজেই সরলীকৃত ধারণার বশবর্তী হয়ে পড়ে, যা গভীর চিন্তাভাবনার পরিবর্তে দ্রুত মতামত তৈরি করে।

সাহিত্য ও সংস্কৃতিও পাঠকের অভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। নতুন লেখক তৈরি হওয়া, তাদের কাজের স্বীকৃতি পাওয়া, সাহিত্যিক আলোচনার বিকাশ– সবকিছুই পাঠকের ওপর নির্ভরশীল। পাঠক না থাকলে সাহিত্যের কদর কমে যায়, এবং ধীরে ধীরে সাহিত্যিক সৃজনশীলতাও ধাক্কা খায়। একটি জাতি যখন পাঠক হারায়, তখন তারা নিজেদের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে পারে, কারণ বইই ছিল সেগুলোর প্রধান ধারক।

ফিরিয়ে আনা যাবে কি সেই হারানো পাঠককে? আশার আলো কি নিভে গেছে?
পাঠকের এই অকাল প্রয়াণ রোধ করা কি সম্ভব? এর উত্তর খুব সহজ নয়, কারণ আমরা এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছি। তবে কিছু উদ্যোগ হয়তো আশার আলো দেখাতে পারে:

শৈশব থেকেই পঠন অভ্যাসকে আকর্ষণীয় করে তোলা: ছোটবেলা থেকেই শিশুদের মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ তৈরি করতে হবে। গল্পের বই, কমিকস, ম্যাগাজিন– যা তাদের আনন্দ দেবে, তাই তাদের হাতে তুলে দিতে হবে। শুধু বই নয়, অডিওবুক এবং ইন্টারেক্টিভ ই-বুকও এক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। পঠন প্রক্রিয়াকে একটি খেলার মতো করে উপস্থাপন করলে শিশুরা এতে আগ্রহী হবে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা: স্কুল-কলেজে পঠন-পাঠনকে শুধু পরীক্ষার সিলেবাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে বই পড়ার প্রতি ভালোবাসা তৈরি করতে হবে। পাঠচক্র, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, লেখক-পাঠক আড্ডা আয়োজন করা যেতে পারে। লাইব্রেরিগুলোকে আরও আধুনিক ও আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে, যেখানে কেবল বই নয়, পঠন-বান্ধব পরিবেশও থাকবে।

ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সাহিত্যের নতুন রূপ: অনলাইন বিভিন্ন সাহিত্য গ্রুপ তৈরি করা, সাহিত্য আলোচনা করা, গল্প-কবিতা আপলোড করার মাধ্যমে ডিজিটাল মাধ্যমেই পাঠককে সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট করা যেতে পারে। পডকাস্ট, ভিডিও রিভিউ, এবং ইনফোগ্রাফিক্সের মাধ্যমে বইয়ের বিষয়বস্তু উপস্থাপন করা যেতে পারে, যা ডিজিটাল প্রজন্মের কাছে আরও আকর্ষণীয় হবে।

লেখকদের নতুন প্রচেষ্টা: লেখকদেরও এমন বিষয়বস্তু এবং উপস্থাপনা নিয়ে কাজ করতে হবে যা আজকের পাঠকদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে। ছোট আকারের লেখা, কিন্তু গভীর বিষয়বস্তু, কিংবা এমন ফিকশন যা ডিজিটাল জীবনকে প্রতিফলিত করে, তা হয়তো পাঠককে আবার বইয়ের দিকে ফিরিয়ে আনতে পারে। ইন্টারেক্টিভ ফিকশন বা মাল্টিমিডিয়া সমৃদ্ধ সাহিত্যও একটি নতুন দিক হতে পারে।

পঠন উৎসব ও সাহিত্য মেলা: বইমেলা বা সাহিত্য উৎসবগুলোকে কেবল বই কেনা-বেচার কেন্দ্রে সীমাবদ্ধ না রেখে, সেগুলোকে পঠন ও সাহিত্য চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে হবে। এখানে আলোচনা, সেমিনার, ওয়ার্কশপ, এবং পাঠকের সাথে লেখকের সরাসরি যোগাযোগের সুযোগ তৈরি করতে হবে।

ডিজিটাল বিপ্লবকে আমরা থামাতে পারবো না, তবে এর সাথে খাপ খাইয়ে পাঠককে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। পাঠকহীন সমাজ এক শূন্য মস্তিষ্কের মতো, যেখানে তথ্যের প্রাচুর্য থাকলেও জ্ঞানের আলোকবর্তিকা অনুপস্থিত। যদি আমরা পাঠককে ফিরিয়ে আনতে না পারি, তবে মানবজাতির জন্য এক নতুন সংকট তৈরি হতে পারে – যেখানে তথ্য থাকবে, কিন্তু সেই তথ্যকে জ্ঞান এবং প্রজ্ঞায় রূপান্তরের জন্য প্রয়োজনীয় পাঠকের অভাব দেখা দেবে। পাঠকের পুনরুত্থান কি তাহলে কেবলই একটি স্বপ্ন, নাকি এটি আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ এক নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মই দেবে।

লেখক : গবেষক।
[email protected]

মন্তব্য করুন