শুক্রবার, ১৬ মে ২০২৫, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
জাতীয়প্রবাস বাংলাঅপরাধবাণিজ্যরাজনীতিঅন্যান্যসারাদেশমতামতস্বাস্থ্যফিচাররাজধানীপাঠকের কথাআবহাওয়াশিল্প-সাহিত্যগণমাধ্যমকৃষি ও প্রকৃতিইসলামবৌদ্ধহিন্দুখ্রিস্টানআইন-বিচারবিবিধআপন আলোয় উদ্ভাসিতবেসরকারি চাকুরিসরকারি চাকুরি Photo Video Archive

শুক্রবার, ১৬ মে ২০২৫, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ভালোবাসা আসলে কাকে বলে?

রহমান মৃধা|
  ১৪ মে ২০২৫, ১৯:২৩ | GMT +6
রহমান মৃধা

সখী, ভাবনা কাহারে বলে? যাতনা-ই বা কী? এসব প্রশ্ন যখন মাথায় আসে, তখন বুঝতে পারি—যে ‘ভালোবাসা’ শব্দটি আমরা প্রতিদিন উচ্চারণ করি, তার প্রকৃত অর্থ আসলে আমরা অনেকেই জানি না। ‘ভালোবাসা’—এই শব্দটি দিনের পর দিন, রাতের পর রাত শুনি আমরা, তবুও প্রশ্ন রয়ে যায়: ভালোবাসা আসলে কাকে বলে?

এই শব্দটি কত সহজে বলে ফেলি—কখনো বিশেষ মুহূর্তে, কখনো নিছক অভ্যাসে। অথচ এই একটিমাত্র শব্দের ভেতরে লুকিয়ে থাকে এমন এক সমুদ্র, যার গভীরতা কেউ কোনোদিন সম্পূর্ণরূপে মাপতে পারেনি। ভালোবাসা আসলে কী?

এটা কি শুধু হৃদয়ের নিঃশব্দ স্পন্দনে আটকে থাকা কোনো আবেগময় অনুভূতির নাম? না কি এমন এক অন্তর্গত যন্ত্রণা—যা আনন্দের মতোই নিঃশব্দে এসে হৃদয়ের গভীরে ছায়া ফেলে?

একটা সময় ছিল, যখন ভালোবাসা মানেই ছিল অপেক্ষা। প্রেম ছিল অলিখিত এক চিঠির মতো—যা শুধু চোখে লেখা হতো, আর হৃদয়ে পড়া যেত। তখন মানুষ ভালোবাসতো ধৈর্য ধরে, শব্দ ছাড়া কথা বলতো, ছুঁয়ে না গিয়েও ছুঁয়ে দিতো। ভালোবাসা ছিল নিঃশব্দ সন্ধ্যার মতো—যেখানে গোধূলির আলোয় চোখে চোখ পড়তো, অথচ মুখে কোনো শব্দ উচ্চারিত হতো না।

সে সময় ভালোবাসা ছিল গভীর, কিন্তু গোপন। ছিল আত্মত্যাগ, অন্তর্জ্বালা, আর এক ধরনের মিষ্টি কষ্ট—যার ব্যঞ্জনা আজকের সময়ে অনেকেই হয়ত অনুভব করতে পারবে না। তবুও, সেই ভালোবাসা ছিল। তার গভীরতা এতটাই ছিল যে, ভাষায় তা ধরা দিত না।

ভালোবাসা তখন ছিল এক চিঠির প্রতীক্ষা বা নির্দিষ্ট গাছতলায় ঠিক সময়ে এসে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি। একটা না-বলা অনুভব, যাকে হৃদয় বুঝত, ভাষা নয়। আজ, সেই সময় আর নেই।

তবুও সেই ভালোবাসার ছায়া রয়ে গেছে আমাদের স্মৃতির ভেতর, পুরোনো কোনো কবিতার পংক্তিতে, সাদা-কালো ছবির চোখে চোখ রাখার মুহূর্তে—যেখানে দুটি মানুষ একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে, কিন্তু স্পর্শ করেনি, তবুও ভেতরে জ্বলছে এক স্ফুলিঙ্গ।

ভালোবাসা—আজও কি তা আগের মতোই রয়ে গেছে? না কি সময়ের সঙ্গে তার রূপ বদলে গেছে, শব্দ বদলে গেছে, অর্থ হারিয়েছে?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর হয়ত এখনই জানা যাবে না। কারণ ভালোবাসা নিজেই এক দীর্ঘ যাত্রা—প্রশ্ন থেকে প্রশ্নে, অনুভব থেকে অনুভবে। এই যাত্রার শুরু আছে, তবে শেষ নেই।

আর এই লেখাটিও সেই যাত্রার শুরু—একটি অতল ভালোবাসার ইতিহাসে প্রবেশের দ্বারপ্রান্তে—যেখানে তুমি, পাঠক, হয়ত খুঁজে পাবে নিজের কোনো হারিয়ে যাওয়া অনুভব। ভালোবাসার নতুন রূপ: দ্রুততা ও প্রযুক্তির যুগে প্রেম

সময় বদলেছে। সময় কাঁদে না, থেমে থাকে না—সে কেবল চলে যায়, আমাদেরও নিয়ে যায় তার সঙ্গে। আর সেই চলার মাঝেই বদলে যায় সম্পর্কের ভাষা, অনুভবের গভীরতা, ভালোবাসার ধরন।

একুশ শতকের প্রেম একদম ভিন্ন। যে যন্ত্রণা একসময় ভালোবাসার অপরিহার্য অংশ ছিল, তা আজ অনেকটাই বদলে গেছে। এখন অপেক্ষার বদলে দ্রুততা, অভিমানের বদলে ইমোজি, চিঠির বদলে ভয়েস নোট।

প্রযুক্তি আমাদের এনে দিয়েছে এমন এক জগৎ, যেখানে ভালোবাসা পাওয়া যায় এক ক্লিকে, আবার হারিয়েও যায় আরেক ক্লিকে।

ভিডিও কলে চোখে চোখ রেখে মুহূর্তে কথা বলা যায়, মেসেজে লেখা যায় শত আবেগ, আর সোশ্যাল মিডিয়ার এক ঘোষণায় গড়ে ওঠে সম্পর্কের বিশ্ব।

তবে প্রশ্ন রয়ে যায়—

এই ভালোবাসা কি আগের মতো গভীর? এই প্রেম কি সেই দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর এক ঝলক হাসির মতো তৃপ্তিদায়ক? নাকি এটি হয়ে উঠেছে এক ধরনের ভোগ্যপণ্য—চাই, পেয়েছি, হারালে নতুন খুঁজি? ভালোবাসা এখন অনেকটাই তাৎক্ষণিক। সম্পর্ক গড়ে ওঠে, আবার নিঃশব্দেই ভেঙে যায়।

প্রতিশ্রুতি আছে, কিন্তু প্রতীক্ষা নেই। ধৈর্যহীন, দ্রুতবেগে চলমান ভালোবাসা যেন এক ক্লান্ত নিঃশ্বাসের মতো। তবুও, এই পরিবর্তনের মাঝেও কিছু চিরন্তন সত্য রয়ে গেছে—ভালোবাসা এখনও মানুষকে বদলে দিতে পারে। একটি চাহনি, একটি শব্দহীন স্পর্শ এখনও বুক কাঁপিয়ে তোলে। ভালোবাসা এখনও জ্বালাতে পারে হৃদয়ের আলো, আর কিছু সন্ধ্যায় সেই আলোই হয়ে ওঠে নিঃসঙ্গতার একমাত্র আশ্রয়।

ভালোবাসার বিস্তৃতি: একটি মানবিক চেতনার আহ্বান। যখন সারা পৃথিবী জর্জরিত হয়ে পড়ে যুদ্ধ আর ঘৃণায়, যখন বৈষম্য জন্ম দেয় শেকল, যখন মানুষ হয়ে ওঠে কেবলই একটি সংখ্যা—ঠিক তখনই প্রয়োজন হয় এমন এক ভালোবাসার, যে ভালোবাসা সংখ্যার বাইরেও মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখে।

এই ভালোবাসা চায় না কোনো উত্তরাধিকার, দাবি করে না কোনো শর্ত। এটি জানে শুধু দিতে—সম্মান, সহানুভূতি, আর নিঃশর্ত গ্রহণ।

বিশ্ব ভালোবাসার চেতনা। এই বিশ্ব ভালোবাসার চেতনা আজকের পৃথিবীর সবচেয়ে জরুরি সুরক্ষা। যখন এই চেতনা আমাদের হৃদয়ে বাস করে, তখন আমরা বুঝি— ভালোবাসা কেবল দুজন মানুষের মধ্যকার সম্পর্ক নয়। ভালোবাসা হতে পারে একটি জাতির প্রতি, একটি শিশু পাখির প্রতি, একটি বিপন্ন নদীর প্রতি—এমনকি নিজের প্রতিও।

এখন সময় এসেছে প্রশ্ন তোলার—আমরা কি ভালোবাসাকে শুধুই ব্যক্তিগত সম্পর্কে আবদ্ধ রাখবো? নাকি তাকে রূপ দেবো এক মহৎ, সর্বজনীন মানবিক দায়বদ্ধতায়?

ভালোবাসা একটি আয়না। এই সময়ের ভালোবাসা আমাদের সামনে একটি আয়না ধরে রেখেছে। এই আয়নায় যদি আমরা কেবল মুখ দেখি, তবে রূপ খুঁজে পাবো না। কিন্তু যদি হৃদয় দেখি, তবে সেই চিরন্তন আলো এখনো দেখতে পাবো—যে আলো একদিন নদীর ধারে দাঁড়িয়ে থাকা এক জোড়া চোখে ছিল, আর আজ তা ছড়িয়ে আছে পৃথিবীর প্রত্যেকটি আশায়, সংকটে, সম্ভাবনায়।

প্রশ্ন ওঠে—ভালোবাসা কি কেবলই বেদনার উৎস? নাকি তার গভীরে লুকিয়ে আছে আনন্দ, উদ্দীপনা, এবং জীবনের প্রতি এক অপরিমেয় প্রেম? ভালোবাসা: কান্না নয়, আনন্দের গান কবির কণ্ঠে আমরা শুনি এক আশ্বাস—ভালোবাসা কেবল কান্না নয়, এটি এক আনন্দের গান, যা হৃদয়কে প্রসারিত করে, মনকে জাগিয়ে তোলে, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে এক সুর বোনে।

তিনি ডেকে বলেন, ‘আয় সখী, আয় আমার কাছে—সুখী হৃদয়ের সুখের গান শুনিয়া তোদের জুড়াবে প্রাণ।” এই গান কেবল প্রেমিক-প্রেমিকার নয়—এ গান মানবতার, এ গান বিশ্বভালোবাসার। কারণ, যদি প্রতিদিন আমরা শুধু কাঁদি, তবে ভালোবাসার চেতনা নিঃশেষ হয়ে যায়। যদি একদিন সবাই মিলে বিষাদ ভুলে গান গাই, তবে ভালোবাসা তার চূড়ান্ত রূপ পায়— একত্রিত হওয়ার, আলো ছড়ানোর, মানুষকে মানুষ করে তোলার রূপ।

ভালোবাসা: একটি দর্শন, একটি অবস্থান আজকের বৈরী বিশ্ব বাস্তবতায়—যুদ্ধ, ঘৃণা, বৈষম্য, নিপীড়ন, পরিবেশ বিপর্যয়—
এই সবকিছুর সম্মিলিত একমাত্র উত্তর হতে পারে: ভালোবাসা। তবে সেটা কেবল আবেগ নয় বরং এক সার্বজনীন উপলব্ধি—
যেখানে ‘আমি’ নয়, ‘আমরা’ মুখ্য হয়ে ওঠে।

এই সত্য আমি নিজের জীবনে আবিষ্কার করেছি। আমি দেশছাড়া, দূরভূমিতে দাঁড়িয়ে গড়েছি এক ভালোবাসার প্যারাডাইস। এই যাত্রা সহজ ছিল না— ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, সংস্কৃতি এমনকি প্রিয়জনের পূর্বধারণা—সবকিছু এসে প্রশ্ন তুলেছিল আমার হৃদয়ের সিদ্ধান্তে।

তবুও আমি থামিনি। কারণ আমি জানতাম— এই ভালোবাসা কেবল একজন মানুষের জন্য নয়, এটি এক দর্শন, এক বোধ—যেখানে মানুষই প্রধান, হৃদয়ই একমাত্র পরিচয়।

ভালোবাসা আমাকে শিখিয়েছে—এটি কেবল আবেগ নয়, এটি এক দৃঢ় অবস্থান। এটি কেবল কারো হাত ধরা নয়, বরং ঝড়ের রাতে সেই হাত না ছেড়ে থাকা। যখন সমাজ দেয়াল তোলে, সংস্কার বাধা দেয়, তখন ভালোবাসা বলে— ‘আমি সেই দেয়াল দেখি না, আমি মানুষের মন দেখি।’

এই ভালোবাসাই আমাকে শিখিয়েছে— মানবতার প্রতিটি রঙ, প্রতিটি রূপকে গ্রহণ করতে হয়। শিখিয়েছে—মানুষ হবার প্রথম শর্ত হলো, অন্য মানুষকে সম্মান করা। ভালোবাসা বিভাজনের বিপরীতে একতা আমার এই গল্প হয়ত ব্যক্তিগত, তবুও এর ভেতরে আমি অনুভব করি এক সার্বজনীন সত্য—ভালোবাসা কখনো বিভক্ত করে না। ভালোবাসা সবসময় মিলনের পথ তৈরি করে।

এই মিলনই হোক এই সময়ের বিভাজনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে দৃঢ়, সবচেয়ে উজ্জ্বল জবাব। তাই আমি বলি— আজকের ক্লান্ত, বিদীর্ণ পৃথিবীকে যদি সত্যিকার অর্থে রক্ষা করতে হয়, তবে আমাদের চাই ভালোবাসা। কিন্তু তা কেবল রোমান্টিক নয় বরং গভীরতর, বৃহত্তর, মানবিক।

এমন এক ভালোবাসা—যা আবেগকে কাঁটাতারের ভেতর আটকে রাখে না, বরং মুক্ত করে। যা কেবল ভালো না বাসতে শেখায় না বরং অন্যকে ভালোবাসতেও শেখায়। ভালোবাসা—যা কেবল নিজের ঘরের আলো নয় বরং অন্ধকারে থাকা অন্যের ঘরেরও বাতি জ্বালায়।

ভালোবাসা হোক আমাদের নতুন ধর্ম একটি ধর্ম, যা কারো বিরুদ্ধে নয়—বরং সবার পক্ষে। একটি ধর্ম, যেখানে নেই কোনো বিধিনিষেধ, নেই ভয় কিংবা বিভাজন— আছে কেবল হৃদয়ের ঋতু, আর মানুষের প্রতি মানুষের সম্মান। ভালোবাসার রূপ সময়ের সঙ্গে বদলাতে পারে, কিন্তু তার মূল সত্তা—আবেগ, সৌন্দর্য, মানবতা—অপরিবর্তনীয়।

আজকের পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রয়োজন—ভালোবাসাকে এমন এক স্তরে উন্নীত করা, যেখানে তা ব্যক্তি-ভিত্তিক নয় বরং এক চলমান শক্তি—যা সমাজ থেকে সমাজে, হৃদয় থেকে হৃদয়ে এবং দেশ থেকে পৃথিবীর কোণে ছড়িয়ে পড়ে এক অনন্ত প্রেম হয়ে।

একটি প্রেম, যা সম্পর্ক গড়ে তোলে—কিন্তু শুধু সম্পর্ক নয়, একটি প্রেম, যা পৃথিবীকেও রক্ষা করে। এভাবেই আমরা পৌঁছাতে পারি
এক অশেষ ভালোবাসার দিগন্তে—যেখানে মানুষ শুধু মানুষ নয়, মানবতাই হয়ে ওঠে ভালোবাসার সবচেয়ে সত্য ও চিরন্তন রূপ।

রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক
(সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন)
[email protected]

মন্তব্য করুন