মঙ্গলবার, ১৩ মে ২০২৫, ৩০ বৈশাখ ১৪৩২
জাতীয়প্রবাস বাংলাঅপরাধবাণিজ্যরাজনীতিঅন্যান্যসারাদেশমতামতস্বাস্থ্যফিচাররাজধানীপাঠকের কথাআবহাওয়াশিল্প-সাহিত্যগণমাধ্যমকৃষি ও প্রকৃতিইসলামবৌদ্ধহিন্দুখ্রিস্টানআইন-বিচারবিবিধআপন আলোয় উদ্ভাসিতবেসরকারি চাকুরিসরকারি চাকুরি Photo Video Archive

মঙ্গলবার, ১৩ মে ২০২৫, ৩০ বৈশাখ ১৪৩২

মা ঝড়ের রাতে আশ্রয় হয়ে ওঠা গৃহকোণ

মাহফুজা অনন্যা, লেখক
  ১১ মে ২০২৫, ১৫:১৫

মা-একটি ছোট্ট শব্দ, তবে এর পরিধি এত বিশাল যে পৃথিবীর আকাশ বা সমুদ্রের কোনো স্তরেও তা ধারণ করা সম্ভব নয়। মায়ের ভালোবাসা নিঃসীম, ত্যাগ অপরিমেয় এবং স্নেহের গভীরতা অতল। প্রতিবছর মা দিবস উদ্‌যাপিত হয় মায়েদের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উদ্দেশ্যে। যদিও একটি দিন কখনোই মায়ের অবদানকে যথার্থভাবে সম্মান জানাতে পারে না, তবুও এই দিনটি আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটি অনন্য সুযোগ করে দেয়।

আজ মা দিবস। বছরের একটি বিশেষ দিন, যখন আমরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম সম্পর্কটিকে একটু গভীর করে অনুভব করি। কিন্তু সত্যি করে বললে একজন মা কি কেবল একটি দিনের ভালোবাসার দাবি রাখেন? একজন মা কি শুধুই সেই মানুষ, যিনি আমাদের জন্ম দেন? না, মা একজন পূর্ণ জগৎ। তিনি জীবন, তিনি জোনাকির আলো, তিনি ঝড়ের রাতে আশ্রয় হয়ে ওঠা গৃহকোণ। মানুষের জীবনে মা-ই প্রথম আশ্রয়, প্রথম শিক্ষক, প্রথম প্রেম, এবং প্রথম প্রেরণা। প্রতিটি শিশু প্রথম ভাষা শেখে মায়ের কণ্ঠে। তাই মা এক হিসেবে ভাষার প্রথম শিক্ষক। ‘মায়ের ভাষা’ শব্দবন্ধটি একটি শক্তিশালী সাংস্কৃতিক ধারণা।

“আন্তর্জাতিক মা দিবস” প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার পালিত হয় সেই অনন্য মমতার আধার, মা-কে শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা জানানোর দিন হিসেবে। এই দিনটি কেবল একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং তা একটি আত্মিক উপলক্ষ-যেখানে মা ও সন্তানের সম্পর্কটি নতুন করে ভাবনায় ও হৃদয়ে স্থান পায়। মা একটি আবেগ, একটি অনন্ত অনুভব। মা শব্দটি ছোট হলেও এর গভীরতা অপরিসীম। মা মানে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, অশেষ ত্যাগ, সীমাহীন ধৈর্য আর নিরন্তর সংগ্রামের আরেক নাম। একটি শিশুর জন্মের আগ থেকে শুরু করে জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে মা যেমন পাশে থাকেন, ঠিক তেমনি সন্তানকে গড়ে তুলতে তিনি যে আত্মত্যাগ করেন, তা ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়।

মায়ের কোলে আমরা প্রথম শান্তি খুঁজি, প্রথম শব্দ বলি, প্রথম কান্না করি, আর তিনিই আমাদের প্রথম হাসির কারণ হন। মা কখনো ছায়া হয়ে থাকেন, কখনো প্রতিরোধ হয়ে রক্ষা করেন, আবার কখনো নিঃশব্দে চোখের জল ফেলেন যেন আমরা কিছু না টের পাই। যে হাত দিয়ে মা আমাদের মুখে ভাত তুলে দেন, সেই হাত দিয়ে তিনি একদিন নিজের ভাগের খাবারও আমাদের পাতে তুলে দেন। নিজের ক্লান্তি ভুলে গিয়ে সন্তানের স্কুল, অসুখ, চাওয়া-পাওয়া, স্বপ্ন— সবকিছুর ভার তিনি নিজের কাঁধে তুলে নেন।

মা মানে নিঃস্বার্থতা। মা মানে আত্মত্যাগ। একজন মা তার অস্তিত্ব দিয়ে তৈরি করেন সন্তানকে মানুষ করার ভিত। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমরা কি সবসময় এই ত্যাগের মর্যাদা দিই? আমরা বড় হয়ে গেলে, হয়তো ব্যস্ত হয়ে পড়ি জীবনের নানা যন্ত্রণায়, কিন্তু মায়ের পৃথিবী তখনও শুধুই আমাদের ঘিরে। মা তখনও অপেক্ষায় থাকেন-একটা ফোনকল, একটা খবর, একটা ছোট্ট ভালোবাসার শব্দের জন্য।

তাই মা দিবসে আমাদের শপথ হওয়া উচিত- মায়ের হাসির পেছনের ক্লান্তিটুকু অনুভব করা। মা শুধু একটি সম্পর্ক নয়, মা একটি দায়িত্ব। মা শুধু ভালোবাসার প্রতীক নন, তিনি জীবনের গভীরতম ব্যঞ্জনা। তাকে ভালোবাসা যেন না হয় দায়িত্ব এড়ানোর বাহানা, বরং হয়ে উঠুক প্রতিদিনের প্রণতি। একটি দিন নয়, জীবনের প্রতিটি দিন হোক মা দিবস। প্রতিটি কথা, প্রতিটি কাজ, প্রতিটি স্পর্শ হোক মায়ের জন্য শ্রদ্ধার। কেননা, যেখানে মা নেই সেখানে পৃথিবীও নিঃসঙ্গ।

আধুনিক মা দিবসের সূচনা হয় যুক্তরাষ্ট্রে। অ্যানা জার্ভিস নামের এক নারী তার মাকে সম্মান জানাতে ১৯০৮ সালে এই দিনটি উদ্‌যাপন শুরু করেন এবং পরে এটি একটি জাতীয় দিবসে পরিণত হয়। ১৯১৪ সালে মার্কিন সরকার মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারকে ‘মাদার্স ডে’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই এই দিনটি বিশেষভাবে পালন করা হয়।

আন্তর্জাতিক মা দিবস বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে উদ্‌যাপিত হলেও মূল ভাবনা একটিই-মাকে ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতার অর্ঘ্য নিবেদন। স্কুল-কলেজে আয়োজন হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, দেয়ালপত্রিকায় উঠে আসে মায়ের গল্প। পরিবারে সন্তানরা উপহার, ফুল বা নিজের হাতে তৈরি কিছু দিয়ে মাকে খুশি করার চেষ্টা করে। কিন্তু সবচেয়ে বড় উপহার হলো-মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা ও সময় দেওয়া।

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার সমাজে মায়েদের ভূমিকা অনন্য। তারা পরিবারের মেরুদণ্ড। কিন্তু দুঃখজনকভাবে অনেক মা এখনো অবহেলার শিকার হন, বিশেষ করে বৃদ্ধ বয়সে। এই দিবসটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়-শুধু একদিন নয়, জীবনের প্রতিটি দিনই মা-কে ভালোবাসা ও সম্মান জানানো উচিত। কারণ, একজন মা মানেই সমাজ নির্মাতা। মা শুধু একজন পরিবারের অভিভাবক নন, তিনি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ার কারিগর। একজন আদর্শ মা যেমন সন্তানের ভিত গড়ে তোলেন, তেমনি তিনি সমাজেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলেন। একজন মা যতটা শিক্ষিত, সচেতন ও মানবিক, তার সন্তান ততটাই গঠনমূলক চিন্তার ধারক হয়।

আন্তর্জাতিক মা দিবস আমাদের শুধু আবেগে ভাসায় না, বরং একটি দায়বদ্ধতার বার্তাও দেয়। মা যেন কোনো বয়সে, কোনো অবস্থায় একা না থাকেন-এটি আমাদের সবার দায়িত্ব। এই দিনে আমরা যেন প্রতিজ্ঞা করি-মাকে প্রতিদিন ভালোবাসব, শ্রদ্ধা করব, এবং তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে আনন্দময় করে তুলব। কারণ, পৃথিবীতে মা-ই একমাত্র মানুষ যিনি নিজের সর্বস্ব দিয়ে ভালোবাসেন বিনিময় ছাড়া সম্পূর্ণ আশাহীনভাবে।

অথচ, গ্রামীণ সমাজে এখনো বহু মা স্বাস্থ্য সেবা শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। মা দিবসে তাদের প্রতি মনোযোগ বাড়িয়ে এই বৈষম্যের কথা বলতে হবে। একক মায়েরা সন্তান লালন পালন করেন দ্বিগুণ দায়িত্ব নিয়ে। তারা শুধু মা নন একই সাথে বাবা, বন্ধু, অভিভাবক -সবই। তাদের এই সংগ্রামকে স্বীকৃতি দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ কাজ। মা শুধু জন্মদাত্রী নন, ভালোবাসার শক্তিতে গড়া সম্পর্ক। দত্তক মা ও সন্তানদের সম্পর্ককে বিশেষভাবে সম্মান জানানো যেতে পারে। আধুনিক মায়েরা প্রযুক্তি ব্যবহার করে সন্তানের খেয়াল রাখছেন, অনলাইনে ক্লাস করছেন, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য নিচ্ছেন- এই রূপান্তরও একটি আলোচনার বিষয় হতে পারে। যে-সব মা সন্তানদের থেকে দূরে থাকেন বিশেষত প্রবাসীদের মা -তাদের নিঃসঙ্গতা এবং আবেগময় চিঠি কল বা ভিডিও কলে -এসব বিষয়ও আলোচনায় আনা যেতে পারে। রক্ত নয়, হৃদয়ের বন্ধনই আসল মায়ার পরিচয়। দত্তক মা যিনি তিনি এ বিষয়টি খুব ভালোভাবে প্রমাণ করেন।

এছাড়াও যারা বাইরে কাজ করেন, তাদের দ্বিগুণ পরিশ্রম করতে হয়-অফিসের কাজ, সংসার সামলানো, সন্তানের পরিচর্যা—সবই একসাথে। তাদের এই আত্মনিয়োগকে শ্রদ্ধা জানানোর আলাদা প্রেক্ষাপট তৈরি করা যায়। মা শুধু একটি শব্দ নয়, এটি একটি আবেগ, একটি শক্তি, একটি সমগ্র পৃথিবীর প্রতিচ্ছবি। আজ আমরা মাকে স্মরণ করবো হৃদয়ের অন্তস্তল থেকে, জানাবো কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।

মা একটি শব্দ, এক মহাসাগর ভালোবাসার অনন্তধারা! মা, যে নামের পেছনে ইতিহাস নে কিন্তু গল্প আছে হাজারো। মা একটি অনন্ত যাত্রার নাম। তিনি শুরু থেকে আছেন, শেষ পর্যন্ত থাকেন। যেদিন আমরা পৃথিবীর আলো দেখি, সেদিন তিনিই প্রথম আমাদের পৃথিবী হয়ে ওঠেন। কিন্তু তাঁর কাহিনি কি কেবল সেখানেই শেষ? দুটো হাত সংসার আর সমাজ গড়ার কারিগর - কর্মজীবী মা।

সমান যত্নে গড়া সমাজ চাই, গ্রামীণ মায়ের কষ্টের স্বীকৃতি চাই। একক মায়েরা ( Single Mothers) একাই লড়ে গড়েছেন জীবন- তারা একক নন, সাহসিকতার প্রতীক। মা কখনো সংসারের স্তম্ভ, কখনো নিঃশব্দ সংগ্রামী, আবার কখনো হয়ে ওঠেন একা এক রক্ষাকবচ। এক জীবনে মা হয়তো নিজেকে হারিয়ে ফেলেন দশ রকমের ভূমিকায়- রাঁধুনি, শিক্ষিকা, সেবিকা, পরামর্শদাতা, রক্ষক, আশ্রয়দাত্রী... কিন্তু তাঁর নিজের জন্য থাকে না কোনো পরিচয়পত্র।তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন তাঁর সন্তান। তিনি যে স্বপ্ন দেখেন, তা সন্তানদের নিয়ে। তিনি যে পথ হাঁটেন, তা সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়তে। মায়ের ভালোবাসা অদৃশ্য, কিন্তু অপরিবর্তনীয়। তার কোনো দাবি নেই, প্রতিদান নেই। তবে একটি সামান্য কষ্টেও তাঁর চোখ ভিজে ওঠে। আমরা হয়তো ভুলে যাই, কিন্তু মা কিছুই ভোলেন না।

মা দিবস আসুক আমাদের মনে করিয়ে দিতে- এই পৃথিবীর জটিলতার মধ্যে, একজন মানুষ আছেন যাঁর ভালোবাসা নিখুঁত, নিঃস্বার্থ এবং নিঃশব্দ। যাঁকে পাওয়া যায় বিনা শর্তে, যিনি কাছে থাকেন না হয়তো সবসময়, কিন্তু তাঁর প্রার্থনা থাকে সবখানে। আমরা যেন তাঁর জন্য সময় রাখি। একটু গল্প, এক কাপ চা, একটা “ভালোবাসি” বলা- এতটুকু কি খুব বেশি চাওয়া?

মায়েদের প্রসব-পরবর্তী বিষণ্নতা ( Postpartum Depression), একাকিত্ব বা আত্মপরিচয়ের সংকট- এই বিষয়গুলো নিয়েও সচেতনতা প্রয়োজন। কারণ মায়ের ভূমিকা শুধু সন্তান জন্মদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং একটি সন্তানের মানসিক, শারীরিক ও নৈতিক বিকাশে তাঁর অবদান অপরিসীম। একজন মা দৈনিক নিজের চাওয়া-পাওয়া, স্বপ্ন ও আরামকে ত্যাগ করে সন্তান ও পরিবারের সুখের কথা চিন্তা করেন। শিশু জন্মের মুহূর্ত থেকে শুরু করে বড় হয়ে ওঠার প্রতিটি পর্যায়ে মায়ের অবদান থাকে নিঃস্বার্থ এবং আত্মোৎসর্গমূলক। মা সন্তানের প্রথম শিক্ষক, যিনি নৈতিকতা, সহমর্মিতা ও জীবনের প্রকৃত শিক্ষার বীজ বপন করেন। সমাজের প্রতিটি স্তরেই মায়ের অবদান অবিচ্ছেদ্য; একজন ভালো মানুষ তৈরির পেছনে একটি "মা" নামক শক্ত ভিত্তি সদা-অবিচল।

প্রতিটি দিবসেরই রয়েছে নিজস্ব মাহাত্ম্য, কিন্তু মা দিবস যেন এক অন্তর্নিহিত আবেগের বহিঃপ্রকাশ। এই দিনে মায়েদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মাধ্যমে আমরা অনুভব করি তাঁদের গভীর ত্যাগ ও ভালোবাসার মূল্য। আমাদের ব্যস্ত জীবনে অনেক সময়ই মায়ের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ অনুচ্চারিত থেকে যায়, তাই মা দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়-মায়ের হাসিই সন্তানের সবচেয়ে বড় শান্তি।

বর্তমানে পৃথিবীর নানা প্রান্তে এমন বহু মা আছেন যাঁরা জীবন সংগ্রামে অবিচল থেকে সন্তানকে মানুষ করার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের এই সংগ্রামকে সম্মান জানানোও মা দিবসের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। সামাজিক পরিবর্তনের ভিড়ে মায়ের ভূমিকা আজও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কর্মজীবী হোক কিংবা গৃহিণী, প্রতিটি মাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে একাধিক দায়িত্ব দক্ষতার সঙ্গে পালন করে চলেছেন। তবে, আধুনিক জীবনের ব্যস্ততা, পারিবারিক দূরত্ব ও প্রযুক্তির দাপটে অনেক ক্ষেত্রেই মা-সন্তানের মাঝে দূরত্ব তৈরি হয়। তাই আজকের দিনে আমাদের ভাবতে হবে- আমরা কি যথেষ্ট সময় দিচ্ছি সেই মানুষটিকে যিনি আমাদের জন্য তার পুরোটা জীবনকে বিলিয়ে দিয়েছেন?

মা দিবস উদ্‌যাপন হতে পারে খুবই সাধারণ, তবুও অর্থপূর্ণ। এক কাপ চা, একটি আন্তরিক আলাপ, কিংবা মায়ের ইচ্ছে মতো কোনো কাজ করার মাধ্যমে আমরা তাঁকে কিছুটা হলেও সুখ দিতে পারি। বাজারের দামি উপহার হয়তো কিছুটা খুশি এনে দিতে পারে, কিন্তু সবচেয়ে মূল্যবান উপহার হলো সময় ও ভালোবাসা। ঐতিহ্যবদ্ধভাবে প্রতিদিন মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা ও দায়িত্ববোধ জাগ্রত রাখাই সত্যিকারের মা দিবসের মর্যাদা বহন করে।

মা প্রকৃতির এক আশ্চর্য সৃষ্টি, যাঁর নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ও ত্যাগের বিনিময়ে পৃথিবীটাকে আমরা আপন মনে করি। মা দিবস আমাদের কাছে শুধু একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং আত্মোপলব্ধির একটি ক্ষণ- যেখানে আমরা খুঁজে পাই নিজেদের ভুল, অবহেলা ও দায়িত্বের গুরুত্ব। প্রতিটি দিন হোক মায়ের প্রতি ভালোবাসা শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের প্রতিচ্ছবি, কারণ - যেখানে মায়ের আশীর্বাদ সেখানে সন্তানের প্রকৃত স্বর্গ।

অনেক সময় মায়ের ভালোবাসা "অধিকারবোধ" হয়ে দাঁড়ায়, যা সন্তানের দাম্পত্য জীবনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। নিচে সেই প্রসঙ্গে একটি বাস্তবসম্মত ও ভারসাম্যপূর্ণ আলোচনা তুলে দেওয়া হলো- যখন মায়ের মমতা রূপ নেয় মালিকানায় তখন সম্পর্কের টানাপড়েন ও সচেতনতার প্রশ্ন ওঠে। কারণ মা-এই শব্দটি শুনলেই আমাদের মনে ভেসে ওঠে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, আত্মত্যাগ ও স্নেহের প্রতিমূর্তি। কিন্তু সম্পর্কের বাস্তবতায় এই সমাজে সবসময় কি সেই চিত্রই থাকে? দুঃখজনক হলেও সত্য, কিছু কিছু ক্ষেত্রে কিছু মা তাঁদের সন্তানদের বিবাহোত্তর জীবনে এমনভাবে হস্তক্ষেপ করেন, যা দাম্পত্য জীবনে অশান্তি ও বিভ্রান্তি তৈরি করে।

এমন অনেক মা আছেন, যাঁরা সন্তানের বিয়ের পরও মনে করেন-সন্তানের প্রতি তাঁর একচ্ছত্র অধিকার রয়েছে। ফলে বউয়ের সঙ্গে স্বাভাবিক মেলামেশা, ঘনিষ্ঠতা বা স্বাধীনতা তাঁদের সহ্য হয় না। তাঁরা অবচেতনভাবে বা সচেতনভাবেই বউকে ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ মনে করেন, এবং তাঁর উপস্থিতিকে নিজের ভালোবাসার ভাগীদার ভাবতে শুরু করেন। এর পিছনে মানসিক কিছু কারণ রয়েছে।

সন্তানের প্রতি আজীবনের ভালোবাসা ও শ্রমের বিনিময়ে অনেক মা মনে করেন, এই সম্পর্কের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ তাদের থাকা উচিত কিন্তু সন্তান যখন নতুন সম্পর্কে জড়ায়, তখন তাদের মনে হয়, তারা অবহেলিত বা তাদেরকে দূরে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে। একা থাকার ভয়, বৃদ্ধ বয়সে আশ্রয় হারানোর আশঙ্কা, অথবা পুত্রবধূর প্রতি অনাস্থা-এসব বিষয় থেকেও এই মনোভাব তৈরি হতে পারে।

বহু পরিবারে আজও পুত্রবধূকে পরিবারের একজন সদস্য না ভেবে ‘আসা’ মানুষ হিসেবে দেখা হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই তৈরি হয় সংকট। এসব কারণে সম্পর্ক গুলো জটিল হয়। স্ত্রীর মনে তৈরি হয় অবমাননার ক্ষত। স্বামী পড়ে দ্বিধার ফাঁদে-একদিকে মা, অন্যদিকে স্ত্রী। ধীরে ধীরে পরিবারের ভিত নড়ে যায়, ভালোবাসা হয়ে পড়ে দায়বদ্ধতা।

সমাজে বা পরিবারে এ ধরনের সমস্যার সমাধানের জন্য সচেতনতা ও সংলাপের প্রয়োজন। মা হিসেবে সন্তানের স্বাধীনতাকে সম্মান জানানো, নতুন সম্পর্ককে স্বীকৃতি দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। অপরদিকে, পুত্রবধূরও উচিত মাকে সম্পূর্ণ দূরে সরিয়ে না রেখে তাঁকে সম্মানের জায়গা দেওয়া। এক্ষেত্রে সন্তানের ভূমিকা রয়েছে। একজন পুত্রের দায়িত্ব- সম্পর্কদুটির ভারসাম্য রক্ষা করা। তিনি যদি স্পষ্ট, সম্মানজনক ও সহানুভূতিশীল অবস্থান নেন, তাহলে ভুল বোঝাবুঝি এড়ানো সম্ভব।

আমাদের সমাজে মা ও বউয়ের সম্পর্ককে ‘প্রতিযোগিতা’ না বানিয়ে ‘সহযোগিতা’র পথে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। মা যদি বুঝতে পারেন যে, পুত্রবধূ তার পুত্রকে ছিনিয়ে নিচ্ছে না- বরং তাঁর সন্তানের ভালোবাসার আরেক নতুন রূপ, তাহলে অনেক জট সহজে খুলে যাবে।

মা হলেন সৃষ্টির আশ্রয়, কিন্তু সেই আশ্রয় যেন কখনো যেন শ্বাসরোধকারী খাঁচা হয়ে না দাঁড়ায়। সন্তানকে ভালোবাসা মানেই তাকে স্বাধীনতা দেওয়া, তার সুখে আশীর্বাদ হয়ে থাকা এটা প্রতিটি মায়ের মনে রাখা জরুরি। ভালোবাসা যদি অধিকার হয়ে দাঁড়ায়, তবে সেটি আর স্নেহ নয়- পরিণত হয় নিয়ন্ত্রণে।

একজন প্রকৃত মা নিজে দূরে দাঁড়িয়ে সন্তানের সুখ দেখে হাসেন, বাধা হয়ে নয়-আশীর্বাদ হয়ে থাকেন। তাই কবিতার ভাষায় মাকে নিয়ে বলা যায়-
মা হলো প্রাণের সুর,
আলোক-দীপ্ত দিগন্তপুর।
পথ দেখায় ঝড়ের মাঝে,
ভরসা দেয় ভাঙা খাঁচে।

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক।

মন্তব্য করুন