এক.
রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে বিচারের মুখোমুখি করার জন্য দেশবাসী যখন ঐক্যবদ্ধ, তখন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দলে ভেড়ানোর একটি ঘোষণা প্রচারিত হয় বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর বরাতে। ৮ মে এক প্রেস কনফারেন্সে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এমনটি বলেছেন বলে মিডিয়া প্রচার করে। খুব কম সময়ের মধ্যেই এ বার্তাটি ভাইরাল হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়।
লন্ডন সময় সকাল সাড়ে ১০টায় অফিসে ঢুকতেই এ বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাজ্য প্রবাসী এক সাবেক ছাত্রদল নেতার ফোন পেলাম। ফোনে তিনি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন তার জেষ্ঠ্য নেতার বিরুদ্ধে। তাকে ফোনে রেখেই আমি সংবাদটি অনলাইনে পড়লাম। তবে বিশ্বাস হলো না। সাংবাদিকতা এবং আইনের এজজন ছাত্র হিসেবে নিজের প্রজ্ঞা দিয়ে ওই ছাত্রনেতাকে আশ্বস্ত করলাম - এ সংবাদটি সঠিক নয়। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কিংবা দলের স্থায়ী কমিটি এমন কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি বলে আমার বিশ্বাস। এটি হয়তো রিজভী আহমদের বক্তব্যের অপব্যাখা হতে পারে অথবা তিনি ভুলে কিছু বলে থাকতে পারেন। এটি সংশোধন করা হবে বলে তাকে আশ্বস্ত করলাম।
এরপরই বিএনপির নীতি নির্ধারকদের একজনের কাছে বিষয়টি আরো নিশ্চিত হলাম এবং দ্রুত সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হলো। কিছুক্ষণ পরেই একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এটি সংশোধন করলেন রুহুল কবির রিজভী আহমেদ।
লেখার শিরোনামের সাথে ওপরের বিষয়টি যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক। কেননা যখন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ এবং দল হিসেবে এর বিচারের দাবি বিরাজমান; তখন দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপির মুখপাত্রের দায়িত্বে থাকা রুহুল কবির রিজভীর পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিএনপিতে সদস্যপদে অর্ন্তভুক্তির ঘোষণা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় এবং সাধারণ মানুষের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে। প্রতিবাদের মুখোমুখি হয়ে রুহুল কবির রিজভী আহমেদ নিজেই দলীয় প্যাডে তাঁর বক্তব্যের ব্যাখা দিয়েছেন। বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন - বিএনপির রাজনীতির মূল লক্ষ্য হলো বাংলাদেশের জনগণের কল্যাণ এবং যারা আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছেন তাদের বিএনপির পতাকাতলে স্থান দেওয়ার বিষয়ে তিনি দলের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন।
দুই.
মূলত: কোনো রাজনৈতিক দলই এখন আওয়ামী লীগের কোনো নেতাকর্মীকে তাদের দলে অন্তর্ভুক্তি করতে চায় না। গোপনে গ্রামগঞ্জে কিংবা বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত হয়ে অথবা ভুলক্রমে কোথাও কোথাও আওয়ামী লীগের নিম্নপর্যায়ের নেতাকর্মীরা বিএনপি - জামায়াত ও এনসিপিতে প্রবেশের চেষ্টা কিন্তু করছে। যেহেতু এই তিনটি দল জুলাই বিপ্লবের বড় স্টেকহোল্ডার তারা না চাইলে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বা জুলাই হত্যাকারী এবং গত ১৭ বছরের গুম-হত্যার বিচার হওয়া সম্ভব নয়। এজন্য এই তিনটি দলের আপাতত: ইস্পাত-কঠিন ঐক্য থাকা জরুরি। অবশ্য রাজনৈতিক অঙ্গনে তাদের সাম্প্রতিক অবস্থান - বক্তৃতা-বিবৃতিতে দৃশ্যত: মনে হচ্ছে - তাদের মধ্যে এখন এ ব্যাপারে কিছুটা ঐক্যমত আছে।
১৯ জানুয়ারি ২০২৫ বাংলাদেশ প্রতিদিন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তৃতা উদ্ধৃত করে সংবাদ করা হয় এবং বলা হয় - ''অনুপ্রবেশকারীদের বিষয়ে দলের নেতাকর্মীদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।' এই বক্তৃতায় তারেক রহমান বলেন, ''সবাইকে সতর্ক থাকতে ও সচেতন থাকতে হবে যেন অনুপ্রবেশকারীরা ঢুকতে না পারেন। গত ১৭ বছরের আওয়ামী লীগের নির্যাতন-অত্যাচার, ত্যাগ ভুলে না গিয়ে প্রত্যেকের নিজেদের মধ্যে জিজ্ঞাসা আসা উচিত... অপরিচিত মানুষগুলোকে কেন বিএনপির কাছে আসতে দেব? নেতাকর্মীদের সতর্ক থাকতে হবে, সচেতন থাকতে হবে। যেন অনুপ্রবেশকারীরা ঢুকতে না পারেন। মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু অনুপ্রবেশকারী নয়।
কাউকে সুবিধা দেওয়ার জন্য বিএনপির নেতাকর্মীরা ১৭ বছর নির্যাতন সহ্য করেনি জানিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বিনীত ও করজোড়ে নেতাকর্মীদের অনুরোধ করেন, মোটরসাইকেলওয়ালা অনুপ্রবেশকারীদের দলে ভেড়াবেন না। ভিড় করতে দেবেন না, বিভ্রান্ত হবেন না, কোনো বিভ্রান্তমূলক কাজ করবেন না। তাদের দলে ভেড়ালে দলীয় নেতাকর্মীদের জন্য ভালো হবে না। অন্য কেউ যদি সরকার গঠন করে, তাহলে রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে মনোযোগ থাকা উচিত, সেটি দলের জন্য ভালো হবে না। মানুষের পাশে দাঁড়ান, তাদের মতো করে নিজেদের তৈরি করতে হবে।
একইভাবে জুলাই বিপ্লবে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্রনেতাদের সমন্বয়ে গঠিত এনসিপির নেতারা অব্যাহতভাবে আওয়ামী লীগ এবং দলটির নেতাদের বিচারের দাবি জানিয়ে আসছেন। গত সপ্তাহ ধরে তারা এ দাবিকে জোরালো করতে জনপ্রচারণা ও লিফলেট বিতরণ কর্মসূচি পালন করেছে। তারা এ দাবিতে ০২ মে ২০২৫ সমাবেশ করেছে। দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে এনসিপি নেতারা ওই সমাবেশে বলেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকার থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে টালবাহানা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হবে, এই সিদ্ধান্ত জনগণ গত বছরের ৫ আগস্টই দিয়েছে। এরপরও কেউ আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টা করলে জুলাই যোদ্ধারা তাদের প্রতিহত করবে।
২৯ এপ্রিল ২০২৫ দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদে জামায়াত ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানের বরাতে বলা হয় - আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন জনগণ মেনে নেবে না। এক ফেসবুক পোস্টে তিনি বলেন, ''এখন দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য পতিত ফ্যাসিবাদীরা দেশের ভেতরে-বাইরে নানান ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। বাংলাদেশের নির্যাতিত ১৮ কোটি মানুষের দাবি হলো, গণহত্যাকারীদের বিচার। চব্বিশের শহীদ পরিবারগুলোর পুনর্বাসন। আহত-পঙ্গু অসংখ্য ছাত্র-তরুণ-যুবক-মুক্তিকামী মানুষের সুচিকিৎসা। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে ১৫ বছরের সৃষ্ট জঞ্জালগুলোর মৌলিক সংস্কার সাধন করে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করা।''
প্রকৃতপক্ষে ডা. শফিকুরের ঘোষণায় তাঁর দল আওয়ামী লীগের বিচারের পক্ষে এবং আওয়ামী লীগের কোনো কর্মীকে তাঁর দলে অন্তর্ভুক্তির বিপক্ষে। এরপরও একই দিনে সাতকানিয়ার বাজালিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক মো. সোলাইমানকে জামায়াতের স্থানীয় নেতারা তাদের সহযোগী সংগঠনের সদস্য ফরম পূরণ করান এবং পরবর্তীতে দু:খ প্রকাশ করেন।
এই তিন দলের অবস্থান যত দৃঢ় হবে, বাংলাদেশে জুলাই বিপ্লবের ফ্যাসিবাদ বিরোধী চেতনা বজায় থাকবে। এই বিচার প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের পাশাপাশি একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রত্যাবর্তনে অন্তবর্তী সরকার সচেষ্ট হবে বলে প্রত্যাশা রাখি।
মূলত: তিনটি কারণে ওপরের কোনো দলই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ঘোষণা দিয়ে দলে ভেড়াতে চায় চাইবে না।
প্রথমত: আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে গত দীর্ঘ ১৬ বছরে ফ্যাসিবাদী মানসিকতা গড়ে উঠেছিল। ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা স্বাভাবিক সামাজিক জীব হিসেবে নিজেদের মনে করতো না। আত্মীয়স্বজনের সাথেই তাদের আচরণে ফ্যাসিবাদের ছাপ ছিল। দুর্নীতি-অনিয়মের মাধ্যমে সম্পদ অর্জনের একটি মহোতসবে মেতে উঠেছিল তারা। এমন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের জাতীয় এবং স্থানীয় নেতারা যে কেনাে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হলে তারা সাধারণ মানুষের রোষাণলে পড়বে। এমনকি নতুন কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষ নিয়ে জনগণের সামনে গেলে তারা প্রতিরোধের মুখে পড়বেন - যা ওই নতুন দলকেই বেকায়দায় ফেলবে।
দ্বিতীয়ত: আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হাতে এখন অনেক কালো টাকা। তাদের কালো টাকার হিসাব নিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তেমন বড় কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এখন ওই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বিএনপি-জামায়াত বা এনসিপিতে যোগদান করলে তারা এসব দলকে গিলে খাবে। মানে এমনভাবে প্রভাব বিস্তার করবে যে - এসব দলগুলোর দীর্ঘ পোড়-খাওয়া এবং সর্বশান্ত নেতাকর্মীরা আওয়ামী লীগের নব্য যোগ দেয়াদের ভিড়ে হারিয়ে যাবে অথবা অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে - যা এসব দলের মধ্যে ভীবিষিকাময় পরিস্থিতির তৈরি করবে।
তৃতীয়ত: আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা কোনো প্রকার বিচারের মুখোমুখি না হয়ে যদি বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপিতে যোগদানের মাধ্যমে এবারের মতো মাফ পেয়ে যায়, তাহলে ভবিষ্যতে তারা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেব। সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে একসময় তারা এমন দানব হয়ে উঠবে যে জুলাই বিপ্লবের স্টেকহোল্ডারদের বেকায়দায় ফেলতে তাদের বেশি সময় লাগবে না এবং এই পথ ধরেই ফ্যাসিবাদ পুনরায় ফিরে আসার সুযোগ পাবে। আওয়ামী লীগের রাজনীতি নতুনভাবে বাংলাদেশে গড়ে উঠবে। যেখানে জুলাই বিপ্লবে জড়িতদের একসময় বিচারের মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা থাকবে।
এসব কারণে কোনো দলই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের তাদের দলে অন্তর্ভুক্তির সুযোগ দেবে না বলেই আপাতত মনে হচ্ছে। তবে ভোটের রাজনীতিতে হিসাব কিছুটা পাল্টে যেতে পারে। তবে সেটাই সচেতনভাবেই জুলাই বিপ্লবের স্টেকহোল্ডারদের খেয়াল রাখতে হবে।
তিন. এমন পরিস্থিততে বাংলাদেশে এখন দরকার জুলাই বিপ্লবের সব স্টেকহোল্ডারের মধ্যে সমন্বয় এবং ঐক্যমত। আর এক্ষেত্রে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি, হেফাজত, চরমোনাই, বামপন্থি সব দলকে নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি মাসে দু'বার বৈঠক করা জরুরি। যে কোনো জাতীয় স্বার্থের সিদ্ধান্ত নিতে শুধু উপদেষ্টা পরিষদ নয়, বিপ্লবের অংশীদার রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে পরামর্শ করতে হবে।
অন্যথায়, অচিরেই এই সরকার আরো দুর্বল হতে থাকবে এবং একসময় লক্ষ্যভ্রষ্ট হতে বাধ্য। আর এটা হবে - বাংলাদেশের মানুষের মনে লালিত নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নের হত্যার শামিল। আর এই হত্যার দায় অন্তর্বর্তী সরকারকে নিতে হবে এবং বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ তাদের রক্তের ঋণ খুঁজবে তাদের কাছে। এরপরও রাজনৈতিক দলগুলোকে এককাতারে বসাতে ব্যর্থ হলে ড. মুহাম্মদ ইউনূস সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সহযোগিতা নিতে পারেন। এখনো বাংলাদেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের কাছে বেগম খালেদা জিয়া শ্রদ্ধার আসনে আছেন। হোক সেটা তাঁর জোটের সাবেক নেতা কিংবা ইসলামিক দলগুলো।
অতএব, সকল রাজনৈতিক দলের মধ্যে একটি ঐক্যমত প্রতিষ্ঠা করে আওয়ামী লীগকে বিচারের মুখোমুখি করা এবং নির্বাচন আয়োজনে ড. ইউনূস সরকারের মনোযোগী হওয়া জরুরি। আবার, এটাও মনে রাখা উচিত - ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো একজন বিশ্ব নেতা আছে বলেই ফ্যাসিবাদের পতনের পর বাংলাদেশ রাষ্ট্র ধীরে ধীরে সামনে এগুতে পারছে। নতুন গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় এসে আবার ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকায় রেখে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারলে স্বপ্নের বাংলাদেশ দ্রুতই বিশ্বপরিমন্ডলে প্রভাবশালী অবস্থানে যেতে সক্ষম হতে পারবে।
লেখক: সাংবাদিক ও আইনজীবী।
[email protected]
মন্তব্য করুন