ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী সবাই মিলেমিশে সম্প্রীতির সাথে বসবাস করার শিক্ষাই ইসলাম আমাদের দিয়েছে। ইসলাম হচ্ছে হীরক সদৃশ স্বচ্ছ সুন্দর এক শান্তি। যে কোনো আঙ্গিক থেকেই এটাকে দেখা হোক না কেন, এটা হচ্ছে অবিমিশ্র শান্তি, খাঁটি শান্তি এবং শান্তি ভিন্ন আর কিছুই নয়।
প্রেম প্রীতি, সৌহার্দ্য আর শান্তি ও সম্প্রীতির এক পরিমণ্ডল বিশ্বজুড়ে প্রতিষ্ঠিত করাই ইসলামের মূল লক্ষ্য। ইসলামের এই আকর্ষণীয় শিক্ষার প্রচার ও প্রসার জোর জবরদস্তি এবং বল প্রয়োগে নয় বরং সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির দ্বারা মানুষের হৃদয় জয় করার মাধ্যমে। বল প্রয়োগ করলে অন্যের অধিকার যেমন দেয়া যায় না, তেমনি আল্লাহতায়ালার নৈকট্যও লাভ করা যায় না।
অনেকে এই প্রশ্নও করে থাকে, ইসলামের শিক্ষা যদি শান্তিই হয়ে থাকে, তাহলে মুসলমানরা যুদ্ধ করেছে কেন? মুসলমানরা যুদ্ধ করার প্রথম উদ্দেশ্য ছিল আত্মরক্ষা করা। শত্রুরা সর্বদা উত্ত্যক্ত করেছে, করেছে আগ্রাসী আক্রমণ, তখন মুসলমানরা আত্মরক্ষা করতে অস্ত্র তুলে নিতে বাধ্য হয়েছে।
দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিল নিরস্ত্র মুসলমানদেরকে যখন অবলীলায় পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হচ্ছিল, তখন অহেতুক এই রক্তপাত ঠেকাতে এবং নির্মম নিষ্ঠুরতার শাস্তি দিতে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। আরবদের রীতি ছিল এটা, আর শান্তি বজায় রাখতে এর অবশ্য প্রয়োজনও ছিল এবং সে ধারা আজও সর্বত্র স্বীকৃত। তৃতীয়ত, যুদ্ধ করা হলে তা করা হয়েছে বিরোধীদের দুর্বল করতে, কেননা তারা একত্রিত হচ্ছে মুসলমানদেরকে নির্মূল করতে, শুধু এ কারণে, তারা এক আল্লাহর ইবাদত করে। এ অবস্থায় যুদ্ধ করা না হলে কাফিররা একজন মুসলমানকেও বাঁচতে দিত না।
মহান আল্লাহতায়ালা যথার্থই বলেছেন, ‘ঠেকানো না হলে তারা মঠ, মন্দির, গির্জা, সিনেগগ এবং মসজিদগুলোকে ধূলিসাৎ করবে আর নির্মম নিষ্ঠুরতা ক্রমেই বেড়ে চলবে।’ তবে এটা ঠিক, মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধিতে যুদ্ধের প্রয়োজন কখনও ছিল না। ইতিহাস এই সাক্ষ্যই বহন করছে, মুসলমানরা কোন যুদ্ধে জড়িয়ে গেলেও কোনো একজনকেও মুসলমান হতে কখনও বাধ্য করা হয়নি। প্রত্যেক ব্যক্তিরই ইবাদতের স্বাধীনতা আছে।
যুদ্ধ-পরিস্থিতিতে মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুনির্দিষ্ট করে বলে দিতেন, ‘বয়োবৃদ্ধদের, নারীদের এবং শিশুদের অনিষ্ট করবে না আর উপাসনালয়ের ক্ষতি সাধন করবে না।’ এমনকি বৃক্ষরাজি পর্যন্ত তিনি কর্তন করতে নিষেধ করেছেন। মুসলমান দেশগুলোতে খ্রিষ্টান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা যাতে তাদের অধিকার সঠিকভাবে ভোগ করতে পারে, সেজন্য অমুসলমানদের থেকে ‘জিজিয়া’ অর্থাৎ ‘নিরাপত্তা ঝুঁকি কর’ নেয়া হতো। আর কারও যদি তা দেয়ার সামর্থ্য না থাকতো, তবে তা আদায় করা থেকে তাকে অব্যাহতিও দেয়া হতো।
ইসলামে মুসলমান ও অমুসলমানের সম-অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। ইসলাম শত্রুদের সাথেও দয়ার্দ্র আচরণ করে, তা শান্তিকালীন সময়েই হোক বা যুদ্ধাবস্থায়ই হোক। সর্বাবস্থায় ইসলাম অমুসলমানদের অধিকার মর্যাদার সাথে সংরক্ষণ করে। কী পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছিল, যখন সর্বশক্তিমান আল্লাহ মুসলমানদেরকে যুদ্ধের অনুমতি দিলেন? মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ বলেন, ‘আর যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে তোমরা আল্লাহর পথে তাদের সাথে যুদ্ধ কর এবং সীমালঙ্ঘন করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৯০)।
বিদ্বেষ ছড়ানো ও আক্রমণের অধিকার ইসলামে নেই। চড়াও হওয়া বা আক্রমণ করার অধিকার ইসলামে নেই। ইসলামের বাস্তব শিক্ষা হলো, কেবল আক্রান্ত হলেই তুমি যুদ্ধ করতে পার। কিন্তু আজ আমরা কি দেখছি, সুন্দর সাবলীল ও সুগঠিত এই সব ইসলামি শিক্ষার ওপর বিশ্বের অধিকাংশ দেশই আমল করছে না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বোমা হামলাকারীরা শিশু, নারী, বৃদ্ধ, নির্বিশেষে সবাইকে হত্যা করে। তারা নগরগুলোতে ব্যাপক ধ্বংস যজ্ঞ চালিয়ে নগর অবকাঠামো সমূলে বিনাশ করছে। এতে নাগরিক অধিকারের কিছুই আর অবশিষ্ট থাকছে না।
প্রতিটি বৃহৎ শক্তিই এখন পারমাণবিক বিপুল অস্ত্র সম্ভারের অধিকারী, এমনকি দরিদ্র দেশগুলো পর্যন্ত অস্ত্রসম্ভার মজুত করণের এই দৌড়ে শামিল হচ্ছে। মানবজাতি একেবারে ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে গেছে, যেখানে কিনা পবিত্র কুরআন আমাদেরকে নিরপরাধ, নিরীহদের কোন ক্ষতি না করার শিক্ষা দেয়, সেখানে পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ তাৎক্ষণিকভাবে জানমালের বিপুল ক্ষতি সাধন করা ছাড়াও শারীরিক প্রতিবন্ধীতা ঘটায়, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চলতেই থাকে। সুতরাং এটা তো হত্যা করার চেয়েও জঘন্যতর অপরাধ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পারমাণবিক বোমা ব্যবহৃত হওয়ার পর মানুষ ভেবেছিল বিশ্ব এমন এক মারাত্মক মারণাস্ত্র বানানো থেকে হয়ত বিরতই থাকবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো সেসব অস্ত্রের প্রাণ সংহারী ক্ষমতা বাড়াতে তারা আরও এগিয়ে গেছে। আর নিশ্চিতভাবেই বিশ্ব সামগ্রিক ধ্বংসলীলা সাধনকারী মারণাস্ত্রের উন্নত-সংস্করণ উদ্ভাবনের উদ্দেশ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতার দৌড়ে ছুটেই চলছে।
মূলত একজন মুসলমানের বিনা কারণে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার অনুমতি নেই, যদি না তা এমন লোকদের বিরুদ্ধে হয়, যারা আল্লাহর দ্বীন পালনে ও প্রচারে বাধা দেয় অথবা বিশ্বে শান্তি বিনাশের কারণ হয়। শান্তি বজায় রাখতে এটা অনুপম সৌন্দর্যমণ্ডিত শিক্ষা নয় কি?
আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘আর তারা সন্ধির জন্য হাত বাড়ালে তুমিও এর জন্য হাত বাড়িয়ে দিও এবং আল্লাহর ওপর ভরসা করো। নিশ্চয় তিনিই সর্বশ্রোতা-সর্বজ্ঞ’ (৮: ৬১)। সুতরাং এটাই হলো ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা।
শুধু তাই না অমুসলমানদের উপাসনালয়ে হামলাকেও ইসলাম কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। অমুসলমানরা যেগুলোর উপাসনা করে সেগুলিকে গালমন্দ করতেও বারণ করে ইসলাম। পবিত্র কুরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন- তোমরা তাদেরকে গালি দিও না, যাদেরকে তারা আল্লাহকে ছেড়ে উপাস্য রূপে ডাকে, নতুবা তারা অজ্ঞতার কারণে শত্রুতাবশত: আল্লাহকে গালি দিবে (সুরা আনআম: ১০৯)। ফলে ইসলাম সকল ধর্মাবলম্বীদের মাঝে এক সামাজিক সম্প্রীতি সৃষ্টির ব্যবস্থাপত্র দিয়েছে।
ইসলাম সোনালি এক নীতি নির্ধারণ করেছে, যা সকল মানুষই অনুসরণ করতে সক্ষম এবং ইসলামের এই চমৎকার শিক্ষা গ্রহণ করলে সবাই উপকৃত হতে বাধ্য। ইসলাম এ শিক্ষা দান করে যে, সব আচরণের ভিত্তি সর্বদাই ন্যায়বিচারের ওপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক ইরশাদ করেন, ‘হে যারা ইমান এনেছো, আল্লাহর ব্যাপারে স্থির-সংকল্প হও, সাক্ষ্যদানে নিরপেক্ষতা বজায় রাখো এবং মানুষের শত্রুতা যেন তোমাদের ন্যায়-বিচারহীন কোনো কাজে প্ররোচিত না করে। সর্বদাই ন্যায়পরায়ণ হও, সেটাই হচ্ছে সততার অধিকতর নিকটবর্তী এবং আল্লাহ্কে ভয় কর। তোমরা যা কর, সে বিষয়ে আল্লাহ্ অবশ্যই অবগত আছেন’ (সুরা মায়েদা, আয়াত: ৮)। একথা এটাকে স্পষ্টভাবে খোলাসা করেছে যে, ইসলামের প্রকৃত অনুসারীদের ওপর এটি নির্ধারিত করা হয়েছে, শত্রুদের সাথেও যেন তারা ন্যায্যতার নিরিখে আচরণ করে আর তাদের সাথে ন্যায় বিচার করে।
মূলত ইসলাম এমন এক শান্তিপ্রিয় ধর্ম, যা ঐক্য ও সহযোগিতার অনুপম শিক্ষার বিস্তার ঘটায়। এমন শান্তিপ্রিয় ধর্মের পক্ষে এমন কোনো সম্ভাবনা আছে কি, সমাজে কারো বিরুদ্ধে সহিংসতা অথবা ঘৃণার বিস্তার ঘটাবে? অবশ্যই না। আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে প্রকৃত ইসলামের শিক্ষার ওপর থেকে থেকে জীবন পরিচালনার তৌফিক দান করুন, আমিন।
লেখক: প্রাবন্ধিক, ইসলামি চিন্তাবিদ।
[email protected]
মন্তব্য করুন