বিশ্ব এমএসএমই (ক্ষুদ্র, মাঝারি ও মাইক্রো উদ্যোগ) দিবস ২০২৫ এক যুগান্তকারী সময়ে উদযাপিত হচ্ছে, যখন বৈশ্বিক অর্থনীতি ও সামাজিক কাঠামো এক নতুন অধ্যায়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। এই দিবসের প্রাক্কালে অনুষ্ঠিত হয়েছে দুইটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্মেলন—সেভিয়ায় Financing for Development (FfD4)-এর চতুর্থ অধিবেশন এবং দোহায় Second World Summit for Social Development। এই সম্মেলনগুলো বিশ্ব অর্থনীতির গতিপথ ও সামাজিক উন্নয়নের রূপরেখা নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে।
এমন পরিস্থিতিতে এবারের এমএসএমই দিবসের মূল প্রতিপাদ্য—"টেকসই উন্নয়ন ও উদ্ভাবনের চালিকাশক্তি হিসেবে ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি উদ্যোগের ভূমিকা শক্তিশালীকরণ" (Enhancing the Role of Micro-Small and Medium-sized Enterprises (MSMEs) as Drivers of Sustainable Growth and Innovation)—বিশেষ তাৎপর্য বহন করে, বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য। এই প্রবন্ধটি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এমএসএমই খাতের গুরুত্ব, বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ, এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এমএসএমই খাত কেবল একটি অর্থনৈতিক উপাত্ত নয়, এটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি, স্থানীয় অর্থনীতির বিকাশ, নারীর ক্ষমতায়ন এবং সামাজিক অন্তর্ভুক্তির এক শক্তিশালী মাধ্যম। দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখে। উদাহরণস্বরূপ, নারায়ণগঞ্জের তৈরি পোশাক কারখানা, রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী সিল্ক শিল্প, বা বরিশালের নিপুণ হস্তশিল্প—এগুলো সবই এমএসএমই খাতের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (GDP) প্রায় ২৫ শতাংশ এমএসএমই খাত থেকে আসে। শুধু তাই নয়, শিল্প খাতে মোট কর্মসংস্থানের ৮০ শতাংশেরও বেশি এই খাত নিশ্চিত করে।
এমএসএমই খাত যুবকদের জন্য কর্মসংস্থানের প্রথম ধাপ হিসেবে কাজ করে, গ্রামীণ নারীদের আত্মনির্ভরশীলতার পথ সুগম করে, এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য অর্থনৈতিক প্রবেশাধিকার উন্মুক্ত করে। একজন বেকার যুবক যখন একটি ছোট ব্যবসা শুরু করে, সে কেবল নিজের কর্মসংস্থানই তৈরি করে না, বরং আরো কয়েকজনের জন্য জীবিকার সংস্থান করে। গ্রামীণ নারীরা ঘরে বসে হস্তশিল্প বা খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছে, যা তাদের সামাজিক মর্যাদা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বাড়াচ্ছে। এভাবেই এমএসএমই খাত বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোতে একটি মজবুত ভিত্তি স্থাপন করেছে।
এমএসএমই খাতের সম্ভাবনা যতটা বিশাল, এর বাস্তবতার চিত্র ততটাই জটিল ও সীমাবদ্ধতায় পূর্ণ। বাংলাদেশের অধিকাংশ এমএসএমই এখনও অনানুষ্ঠানিক খাতে পরিচালিত হয়। ব্যবসা নিবন্ধন না থাকায় তারা আইনি সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হয় এবং মূলধন সংগ্রহের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংকিং সেবার বাইরে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, মাত্র ১৫ শতাংশের মতো ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংকিং সেবা গ্রহণ করে। বাকিরা স্থানীয় মহাজন, এনজিও বা আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়, যা তাদের প্রবৃদ্ধি ও উদ্ভাবনের পথে এক বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এই উচ্চ সুদের বোঝা অনেক সময় ছোট উদ্যোগগুলোকে টিকে থাকতেও দেয় না।
এছাড়া, দুর্বল অবকাঠামো এমএসএমই খাতের অন্যতম প্রধান সমস্যা। বিদ্যুৎ সরবরাহ, পরিবহন ব্যবস্থা এবং ইন্টারনেটের সীমাবদ্ধতা ব্যবসার দক্ষতা হ্রাস করে। একটি ছোট কারখানার জন্য নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকা উৎপাদনকে ব্যাহত করে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় পণ্য পরিবহন ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে, যা ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য অসাধ্য। ডিজিটাল বৈষম্যও একটি বড় চ্যালেঞ্জ; যেখানে শহরাঞ্চলের উদ্যোক্তারা ইন্টারনেট ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের সুবিধা পাচ্ছে, সেখানে গ্রামীণ উদ্যোক্তারা এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটও এমএসএমই খাতকে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি করেছে। ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, এবং দ্রুত পরিবর্তনশীল ডিজিটাল অর্থনীতির বাস্তবতা বিশ্বজুড়ে ছোট উদ্যোগগুলোকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। বাংলাদেশের ছোট রপ্তানিকারকরা ইউরোপের নতুন পরিবেশবান্ধব নীতিমালার সঙ্গে তাল মেলাতে হিমশিম খাচ্ছে। অন্যদিকে, দেশের অভ্যন্তরে মুদ্রাস্ফীতি ও বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি ব্যবসা পরিচালনায় ঝুঁকি বাড়িয়েছে। কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি এবং আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি ছোট উদ্যোগগুলোর মুনাফা কমিয়ে দিচ্ছে, যা তাদের টিকে থাকাকে কঠিন করে তুলছে।
এতসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, এমএসএমই খাতের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো এর অসাধারণ অভিযোজন ক্ষমতা এবং উদ্ভাবনশীলতা। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলোর মধ্যে ইতোমধ্যে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি, কৃষিভিত্তিক প্রক্রিয়াজাতকরণ, ডিজিটাল পরিষেবা, এবং নারীর নেতৃত্বাধীন উদ্যোগে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, 'iFarmer' এর মতো প্রযুক্তি-নির্ভর কৃষি উদ্যোগগুলো কৃষকদের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে। 'জুট ডাইভার্সিফিকেশন প্রমোশন সেন্টার' থেকে পরিচালিত পরিবেশবান্ধব পাটের পণ্যের প্রচার প্রমাণ করে যে, ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলোর মধ্যেই টেকসই উন্নয়নের ভিত্তি নিহিত। এসব উদ্ভাবনকে বিস্তৃত করতে হলে প্রয়োজন লক্ষ্যভিত্তিক অর্থায়ন ও প্রযুক্তিগত সহায়তা।
উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা এবং সীমিত সম্পদের মধ্যেই নতুন সমাধান খুঁজে বের করার ক্ষমতা এমএসএমই খাতকে অনন্য করে তুলেছে। অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা স্থানীয় কাঁচামাল ব্যবহার করে পরিবেশবান্ধব পণ্য তৈরি করছে, যা স্থানীয় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করছে এবং পরিবেশ সুরক্ষায় অবদান রাখছে। সামাজিক উদ্যোগগুলোও ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে, যেখানে মুনাফার পাশাপাশি সামাজিক প্রভাবকেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এই ধরনের উদ্যোগগুলো দেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশে এমএসএমই খাতে অর্থায়নের অভাব একটি কাঠামোগত সংকট। এই খাতে আর্থিক চাহিদার বিপরীতে অপর্যাপ্ত সরবরাহ প্রায় ২৮০ কোটি মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ ঘাটতি তৈরি করেছে। প্রচলিত জামানত-ভিত্তিক ঋণপ্রদান ব্যবস্থা অধিকাংশ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাকে বাদ দিয়ে দেয়, বিশেষ করে নারীরা যারা নিজের নামে সম্পত্তির মালিক নন। এই ব্যবস্থার পরিবর্তন আনা অত্যন্ত জরুরি। অর্থায়নকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে বিকল্প জামানতের স্বীকৃতি, ডিজিটাল ঋণ স্কোরিং, এবং ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম চালু করা যেতে পারে।
বিকল্প জামানত: ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের কাছে প্রচলিত অর্থে মূল্যবান সম্পত্তি না থাকলেও, তাদের কাছে ব্যবসায়িক সুনাম, পণ্যের গুণগত মান, বা ভবিষ্যৎ আয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। এগুলোর ওপর ভিত্তি করে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে।
ডিজিটাল ঋণ স্কোরিং: মোবাইল ব্যাংকিং এবং ডিজিটাল লেনদেনের তথ্য ব্যবহার করে উদ্যোক্তাদের ঋণযোগ্যতা যাচাই করা যেতে পারে। এতে ব্যাংকগুলো আরও সহজে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের কাছে পৌঁছাতে পারবে এবং ঝুঁকিও কমবে।
ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম: সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক ক্ষুদ্র ঋণের জন্য গ্যারান্টি প্রদান করলে ব্যাংকগুলো ছোট উদ্যোগে ঋণ দিতে উৎসাহিত হবে। এটি ঋণ ঝুঁকি হ্রাস করবে এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অংশগ্রহণ বাড়াবে।
এসএমই ফাউন্ডেশন এবং পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (PKSF) উদ্যোগগুলো প্রশংসনীয় হলেও তা এখনও প্রয়োজনের তুলনায় অতি সীমিত। এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও শক্তিশালী করা এবং তাদের কার্যক্রমের পরিধি বাড়ানো প্রয়োজন, যাতে আরও বেশি সংখ্যক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তাদের সুবিধা পেতে পারে। বেসরকারি ব্যাংক এবং নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এমএসএমই খাতে বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে হবে।
নীতিনির্ধারণেও সময় এসেছে বড় ধরনের রূপান্তর আনার। ব্যবসা নিবন্ধন, কর প্রদানের জটিলতা হ্রাস, এবং শ্রম আইনের আওতায় ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলোকেও আনা জরুরি। বর্তমানে একটি ব্যবসা শুরু করতে যে খরচ ও সময় লাগে, তা অনেক উদ্যোক্তাকে অনানুষ্ঠানিকভাবে চলতে বাধ্য করে। ডিজিটাল ওয়ান-স্টপ সার্ভিস চালু করে এই প্রক্রিয়াগুলোকে সহজতর করা সম্ভব। একইসাথে স্থানীয় ভাষায় অ্যাক্সেসযোগ্য ইন্টারফেস ও মোবাইল ফিচারের মাধ্যমে সবার জন্য সহজলভ্য করতে হবে।
সহজ ব্যবসা নিবন্ধন: অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে দ্রুত ও কম খরচে ব্যবসা নিবন্ধনের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এটি ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য সময় ও অর্থ সাশ্রয় করবে।
কর ব্যবস্থা সরলীকরণ: ক্ষুদ্র উদ্যোগের জন্য সহজ ও সরল কর ব্যবস্থা চালু করতে হবে, যাতে তারা সহজেই কর প্রদান করতে পারে এবং কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা কমে।
শ্রম আইন বাস্তবায়ন: ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলোকেও শ্রম আইনের আওতায় এনে শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এটি শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করবে এবং শিল্প সম্পর্ক উন্নত করবে।
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে আইনি পরামর্শ এবং ব্যবসায়িক সহায়তা প্রদানের ব্যবস্থা গড়ে তোলা যেতে পারে। এতে উদ্যোক্তারা আইনি জটিলতা সম্পর্কে জানতে পারবে এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
মানবসম্পদ উন্নয়ন এমএসএমই খাতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। অধিকাংশ ক্ষুদ্র উদ্যোগে প্রশিক্ষিত শ্রমিক ও ব্যবস্থাপনাগত দক্ষতার অভাব রয়েছে। এই ঘাটতি পূরণে প্রযুক্তি, পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি, এবং ব্যবসায়িক কৌশলের ওপর প্রশিক্ষণ প্রদান অত্যন্ত জরুরি। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের মাধ্যমে আঞ্চলিক ট্রেনিং হাব গড়ে তোলা যেতে পারে, যেখানে স্থানভিত্তিক চাহিদা অনুযায়ী দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি পরিচালিত হবে। একইসাথে স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উদ্যোক্তা-বিষয়ক শিক্ষাক্রম যুক্ত করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রস্তুত করা যেতে পারে।
প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ: আধুনিক প্রযুক্তি যেমন ডিজিটাল মার্কেটিং, ই-কমার্স, ক্লাউড অ্যাকাউন্টিং এবং ডেটা অ্যানালিটিক্স বিষয়ে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা প্রয়োজন।
পরিবেশবান্ধব অনুশীলন: জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে পরিবেশবান্ধব উৎপাদন প্রক্রিয়া এবং সবুজ প্রযুক্তির ব্যবহার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রশিক্ষণ প্রদান জরুরি।
ব্যবসা ব্যবস্থাপনা কৌশল: ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য মৌলিক ব্যবসা ব্যবস্থাপনা, অর্থায়ন, বাজার গবেষণা এবং গ্রাহক সম্পর্ক উন্নয়ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা উচিত।
ডিজিটাল রূপান্তরও এই খাতের জন্য এক বিশাল সম্ভাবনার ক্ষেত্র। ই-কমার্স, মোবাইল ব্যাংকিং, ক্লাউড অ্যাকাউন্টিং, এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক পরিষেবা—সবই ব্যবসায়িক কাঠামোকে বদলে দিচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ডিজিটাল বিভাজন এখনও বড় বাস্তবতা। শহরাঞ্চলের উদ্যোক্তারা যেখানে দারাজ, ফেসবুক মার্কেটপ্লেস ইত্যাদি প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে এগিয়ে যাচ্ছে, সেখানেই গ্রামীণ উদ্যোক্তারা ইন্টারনেট সুবিধা থেকে বঞ্চিত। 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' উদ্যোগকে নতুন করে এমএসএমই-কে কেন্দ্র করে ভাবতে হবে এবং ডিজিটাল প্রশিক্ষণ, সস্তায় প্রযুক্তি সরবরাহ, ও ইন্টারনেট অবকাঠামোর সম্প্রসারণে গুরুত্ব দিতে হবে।
নারী উদ্যোক্তাদের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করাও একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকার। যদিও বর্তমানে নারীদের নেতৃত্বাধীন এমএসএমই-এর সংখ্যা বাড়ছে, বিশেষ করে হোম-বেইজড ব্যবসা ও সেবা খাতে, তবুও তারা অধিক সামাজিক বাধা, চলাফেরায় সীমাবদ্ধতা ও অর্থায়নের ঘাটতির মুখোমুখি। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য উপযোগী ঋণপণ্য, পরামর্শ কেন্দ্র, ও বাজার সংযোগের সুবিধা নিশ্চিত করে তাদের ক্ষমতায়ন করা প্রয়োজন। একইসাথে সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ায় নারী মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের জন্য নির্দিষ্ট কোটা বা অগ্রাধিকার নিশ্চিত করলে বাজারে তাদের অংশগ্রহণ বাড়বে।
বিশেষ ঋণ পণ্য: নারী উদ্যোক্তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী সহজ শর্তে এবং কম সুদে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। জামানতের পরিবর্তে ব্যবসা পরিকল্পনা বা সামাজিক গ্যারান্টির ভিত্তিতে ঋণ দেওয়া যেতে পারে।
পরামর্শ কেন্দ্র: নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ পরামর্শ কেন্দ্র স্থাপন করা উচিত, যেখানে তারা ব্যবসা পরিকল্পনা, আইনি সহায়তা এবং বাজার কৌশল সম্পর্কে পরামর্শ পেতে পারে।
বাজার সংযোগ: অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এবং স্থানীয় বাজারের সঙ্গে নারী উদ্যোক্তাদের সংযোগ স্থাপন করা প্রয়োজন, যাতে তারা তাদের পণ্য সহজে বিক্রি করতে পারে।
বিশ্ব এমএসএমই দিবস ২০২৫ যেন শুধুমাত্র প্রতীকী উদযাপন না হয়ে ওঠে, বরং হয়ে ওঠে বাস্তব নীতিনির্ধারণ ও কর্মপরিকল্পনার এক সূচনা বিন্দু। আসন্ন সেভিয়া ও দোহা সম্মেলনে বাংলাদেশকে এমন একটি কণ্ঠ হিসেবে উপস্থিত হতে হবে, যে কণ্ঠ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের আর্থিক প্রবেশাধিকার, প্রযুক্তি হস্তান্তর, এবং ন্যায়সঙ্গত বাণিজ্য শর্তাবলির পক্ষে কথা বলবে। এটাই ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক রূপরেখা গঠনের সময়। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং বিনিয়োগ আকর্ষণ করার জন্য বাংলাদেশের এমএসএমই খাতকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উন্নীত করতে হবে।
স্থানীয় সরকার ও সিটি কর্পোরেশনগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনার মতো শহরগুলোর পৌর প্রশাসন ক্ষুদ্র ব্যবসার জন্য বিশেষ জোন নির্ধারণ, লাইসেন্সিং সহজীকরণ এবং ইউটিলিটি সংযোগে সহায়তা দিতে পারে। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারগুলোকে ক্ষুদ্র উদ্যোগ সহায়ক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুললে প্রান্তিক উদ্যোক্তারা উপকৃত হবে। অংশগ্রহণমূলক প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলার মাধ্যমে এমএসএমই খাতকে কেবল সুবিধাভোগী নয়, বরং নীতিনির্ধারণের অংশীদার করে তুলতে হবে। স্থানীয় সরকারের সক্রিয় অংশগ্রহণ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের আস্থা বৃদ্ধি করবে এবং তাদের কার্যক্রমকে আরও সহজ করবে।
বাংলাদেশ অচিরেই স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের পথে অগ্রসর হচ্ছে। এই উত্তরণে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা এবং শুল্ক সুবিধার অবসান। এই নতুন বাস্তবতায় টিকে থাকতে হলে আমাদের এমএসএমই খাতকে হতে হবে অধিক উৎপাদনক্ষম, পরিবেশবান্ধব ও উদ্ভাবনী। আর সেই রূপান্তরের জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত প্রচেষ্টা—সরকার, বেসরকারি খাত, উন্নয়ন সহযোগী এবং নাগরিক সমাজ—সকলের।
এই দিবসে যদি আমরা বুঝতে পারি যে, ময়মনসিংহের এক ক্ষুদ্র মৎস্য খামারে ব্যবহৃত স্মার্ট সেন্সর, খুলনার এক নারী পরিচালিত হস্তশিল্প রপ্তানি ব্যবসা, কিংবা রংপুরের এক মোবাইল সার্ভিসিং দোকানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তরুণের ভেতরেই ভবিষ্যতের বাংলাদেশ লুকিয়ে আছে—তবে সত্যিকারের অর্থে বিশ্ব এমএসএমই দিবস ২০২৫ আমাদের জন্য কার্যকর হয়ে উঠবে। কারণ ক্ষুদ্র উদ্যোগ মানেই ছোট স্বপ্ন নয়, বরং এগুলোর ভেতরেই লুকিয়ে আছে বৃহৎ সম্ভাবনার বীজ। আজ, এখনই সময় সেই বীজকে সেচ দেওয়া এবং টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাওয়া। ক্ষুদ্র উদ্যোগের জাগরণই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তি ও সামাজিক সমৃদ্ধির চাবিকাঠি।
লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।
মন্তব্য করুন