শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫, ১৪ আষাঢ় ১৪৩২
মধ্যপ্রাচ্যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ

ইরান-ইসরায়েল সরাসরি সংঘর্ষে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ ও বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া

আজিজুল আম্বিয়া
  ২৪ জুন ২০২৫, ১২:৫০

যুদ্ধ কি এখন কেবল গাজা বা গলান পর্যন্তই সীমাবদ্ধ? নাকি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ছায়া ধীরে ধীরে মধ্যপ্রাচ্যের বালু ঝড়ে ভেসে আসছে? ২০২৫ সালের এই জুনে, ইরান ও ইসরায়েল সরাসরি সামরিক সংঘাতে জড়িয়েছে—এবং এবার যুক্তরাষ্ট্রও ময়দানে। যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ড্রোন আর ছায়া হামলায়, এখন তা রূপ নিয়েছে স্টিলথ বোমার হুমকিতে। পারমাণবিক কেন্দ্র ধ্বংস, হরমুজ প্রণালী বন্ধের হুমকি, ড্রোনে ছাওয়া আকাশ, আর জ্বালানির বাজারে অনিশ্চয়তা—এটাই কি সেই বহুল আশঙ্কিত “মধ্যপ্রাচ্য মহাসংঘাত”? যখন বিশ্ব অর্থনীতি এখনো ইউক্রেন যুদ্ধের ধকল সামলাতে পারেনি, তখন এই নতুন যুদ্ধ কি আরও একবার বৈশ্বিক স্থিতিশীলতাকে ধাক্কা দেবে? 

এই কলামে বিশ্লেষণ করছি এই উত্তপ্ত যুদ্ধের পেছনের কারণ, সম্ভাব্য পরিণতি এবং কোন পক্ষ সত্যিই কী হারাচ্ছে—বা পেতে চাইছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি শুক্রবার-শনিবার রাতের দিকে মার্কিন বাহিনী "Midnight Hammer" নামে নির্মম বোমাবর্ষণে ইরানের তিনটি মূল পারমাণবিক কেন্দ্র — ফরডৌ, নাটানজ ও ইসফাহান — আক্রান্ত করেছে . B‑2 স্টিলথ বোমার দ্বারা ৩০,০০০‑পাউন্ড “বাংকার বাস্টার” বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে । ইউ.এস ও ইসরাইল উভয়ই এই কেন্দ্রগুলিকে “চরম ক্ষতিগ্রস্ত” হিসেবে বর্ণনা করেছে, যদিও ফরডৌ সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়নি। ইরান তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে এবং হরমুজ সেতু বন্ধ করার ইঙ্গিত দিয়েছে, যা বৈশ্বিক জ্বালানি সরবরাহে প্রভাব ফেলতে পারে। GPS干扰 beobachten গিয়েছে, সিলিং দিয়ে জাহাজ চলাচল প্রভাবিত হচ্ছে। 

ইরানি পার্লামেন্ট হরমুজ সেতু বন্ধের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে; চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনও বাকি ।ইরান সোমবার রাতে ইজরায়েলের বিভিন্ন অঞ্চলে অন্তত দুটি ব্যারেজে বেলিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বহন করে হামলা চালায়, কিছু সফলভাবে প্রতিহত হলেও আঘাত করেছে। একই সঙ্গে ইরান থেকে ৩০টিরও বেশি একমুখী আক্রমণাত্মক ড্রোন লঞ্চ করা হয়েছে; ইস্রায়েলি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অনেক সফলভাবে প্রতিহত করেছে । ইসরায়েলও ইরানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন এলাকায় আকাশ-প্রতিরক্ষা ও ক্ষেপণাস্ত্র প্ল্যাটফর্মে আক্রমণ চালিয়েছে, যেমন তাবরিজে আইআরজিসি সদর দপ্তর ।ইসরায়েলের রাষ্ট্রপতি হের্জোগ জানতে চেয়েছেন যে, ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে না; এটি মার্কিন স্বার্থেই করা হয়েছে ।
বিশ্ব নেতারা—ইউকে, ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া, চীন—সংঘাত রোধ ও কূটনৈতিক চুক্তির জন্য আহ্বান জানিয়েছেন । জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ জরুরিভাবে একত্রিত হয়েছে এবং গঠনমূলক আলোচনা ঘনিয়ে উঠছে । Financial Times বিশ্লেষণে দাবি করা হয়েছে, যদিও শর্ট-টার্মে সাফল্য পাওয়া যায়নি, তবু দীর্ঘমেয়াদে তীব্র উত্তেজনাকেই অপেক্ষায়—এতে তিনিই কোন পক্ষই সত্যিকারভাবে লাভবান হচ্ছে না। 

একদিকে ইরানের পারমাণবিক প্রোগ্রাম বছরের পর বছর পিছিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা, অন্যদিকে হরমুজ সেতু বিচ্ছিন্ন হয়ে বিশ্ববাজারে তেলের দামের প্রভাব পড়তে পারে । রকম পরিবর্তন: ইসরায়েল এক সপ্তাহ ধরে ইরানের ওপর আকাশ-প্রশস্ত হামলা চালাচ্ছিল; এখন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি হস্তক্ষেপ করছে। অবস্থা উত্তপ্ত: ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার পাল্টা যুদ্ধ চলছে, আঞ্চলিক বিপর্যয় সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।আন্তর্জাতিক চাপ: বিশ্ব রাজনৈতিক স্তরে শান্তিপূর্ন সমাধানের জন্য চাপ বাড়ছে; একইসঙ্গে যুদ্ধের ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে।এই যুদ্ধের কারণ হিসেবে  যে বিষয়গুলি চিহ্নিত হয়েছে  তা নিম্নে আলোচনা করার চেষ্টা করছি। ২০১৫ সালের Joint Comprehensive Plan of Action (JCPOA) চুক্তি অনুযায়ী ইরান পারমাণবিক কর্মসূচি সীমিত করেছিল। কিন্তু ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র (ট্রাম্প প্রশাসন) সেই চুক্তি থেকে সরে আসে। এরপর ইরান ধীরে ধীরে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বাড়ায় এবং গোপনে পারমাণবিক অস্ত্রের সক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা চালায় বলে দাবি। ইসরায়েল বরাবরই সন্দেহ করে আসছে যে ইরান গোপনে পারমাণবিক বোমা তৈরি করছে। ইসরায়েল এই সম্ভাবনাকে জাতীয় অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসেবে দেখে।

 ২০২৫ সালে স্যাটেলাইট ফুটেজ ও গুপ্তচরবৃত্তির তথ্য থেকে ইরানের ফরডৌ ও নাটানজ কেন্দ্রে "অত্যন্ত সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম" পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। এরপর ইসরায়েল প্রথম বিমান হামলা চালায়।ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে “রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদে পৃষ্ঠপোষক” বলে অভিহিত করে।ইরান হিজবুল্লাহ (লেবানন), হুথি (ইয়েমেন), হাশদ আল-শাবি (ইরাক) এবং অন্যান্য মিলিশিয়াদের অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে। এই গোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমে ইরান "ইসরায়েল ঘেরাও" কৌশল নিয়েছে বলে দাবি করা হয়। ইরান একটি শিয়া ইসলামিক প্রজাতন্ত্র, এবং ইসরায়েল একটি ইহুদি রাষ্ট্র। ধর্মীয় আদর্শগত বিরোধ বহু দশক ধরে দুই দেশের মধ্যে চরম অবিশ্বাস তৈরি করেছে।বিশেষ করে ইরানের নেতৃত্ব প্রায়ই বলে থাকে: “ইসরায়েলকে মানচিত্র থেকে মুছে দিতে হবে।” 

ইরান হামাস ও ইসলামিক জিহাদ-এর মতো গাজাভিত্তিক গোষ্ঠীদের সমর্থন দিয়ে থাকে, যারা ইসরায়েলবিরোধী সশস্ত্র প্রতিরোধ চালায়। ২০২৪ সালের শেষদিকে গাজায় বড় ধরনের সংঘর্ষের সময় ইরানী ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহের অভিযোগ ওঠে। এর পর থেকেই ইসরায়েল ইরানের সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ তুলে প্রতিশোধের হুমকি দিতে থাকে। ২০২৫ সালের মার্চে সিরিয়ায় ইসরায়েলি হামলায় ইরানের কয়েকজন আইআরজিসি (IRGC) কমান্ডার নিহত হন। এর প্রতিক্রিয়ায় এপ্রিলের শুরুতে ইরান ইসরায়েলের উপর সরাসরি ৩০০+ ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় — এটিই প্রথমবারের মতো ইরান ও ইসরায়েলের সরাসরি যুদ্ধ। এরপর পাল্টা প্রতিশোধ ও এখন যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে যুদ্ধ আরও বড় আকার ধারণ করেছে।এই যুদ্ধের পক্ষে এবং বিপক্ষে কিছু দেশের অবস্হান ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে আসছে । নিম্নে এই বিষয়ে জানানোর চেষ্টা করব। এই যুদ্ধের পক্ষের দেশগুলির সাথে পরিচয় করে দিতে চাই।   মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি সামরিক হামলায় অংশগ্রহণ করেছে (ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রে হামলা)। 

তাদের যুক্তি  ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পথে, এটি বন্ধ করা “জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে”।  প্রেসিডেন্ট ও প্রতিরক্ষা দপ্তর বলছে এটি সীমিত প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ, যুদ্ধ শুরু করার উদ্দেশ্যে নয়। ইসরায়েল মূল যুদ্ধ শুরু করেছে ইরানের উপর সন্ত্রাসী হামলার প্রতিশোধ হিসেবে। তারা বলছেন ,  ইরান তার অস্ত্র ও শিয়া মিলিশিয়া ব্যবহার করে ইসরায়েলের অস্তিত্ব হুমকির মুখে ফেলছে।সৌদি আরব (আংশিক সমর্থন) প্রকাশ্যে সামরিক জোটে নেই, তবে ইরান-বিরোধী অবস্থানের জন্য কৌশলগতভাবে ইসরায়েলের পক্ষের দিকে ঝুঁকে রয়েছে। মূল উদ্বেগ: ইরানি প্রভাব হ্রাস, বিশেষ করে ইয়েমেন ও শিয়া মিলিশিয়াদের মাধ্যমে হুমকি। সংযুক্ত আরব আমিরাত স্পষ্ট অবস্থান না নিলেও, ইরান-বিরোধী কূটনীতিতে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রকে নীরব সমর্থন। এখন যুদ্ধ বিরোধী দেশ ও জোটসমূহের সাথে পরিচয় করে দিচ্ছি , রাশিয়া যুদ্ধের বিরোধিতা করছে, কূটনৈতিক সমাধানের আহ্বান জানাচ্ছে।তাদের যুক্তি হল  মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতা বিশ্ব জ্বালানি বাজারে বিপর্যয় আনবে এবং নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়াবে।  চীন যুদ্ধ থামানোর আহ্বান জানিয়েছে। 

মূল উদ্বেগ: হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে জ্বালানি আমদানি বিঘ্নিত হবে, যা চীনা অর্থনীতির জন্য হুমকি। উল্লেখযোগ্য: চীন সম্প্রতি ইরান-সৌদি আরব শান্তিচুক্তিতে মধ্যস্থতাকারী ছিল। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU)এর অবস্থান: যুদ্ধের বিরুদ্ধে।জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার স্বীকার করলেও যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী হামলায় উদ্বিগ্ন। কূটনৈতিক চেষ্টা: ইউএন, G7 ও অন্য সংস্থার মাধ্যমে যুদ্ধ থামাতে চেষ্টা করছে। তুরস্ক  উভয় পক্ষের সমালোচনা করছে।তাদের বক্তব্য হল  ইসরায়েলের “আক্রমণাত্মক আগ্রাসন” ও যুক্তরাষ্ট্রের “বিস্তারবাদী নীতি” উস্কানিমূলক। ভারত এর অবস্থান  নিরপেক্ষ, তবে কূটনৈতিকভাবে সমঝোতার পক্ষে। মূল উদ্বেগ: তেল সরবরাহে বিঘ্ন ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা। অন্য গোষ্ঠী ও সংঘাত-পক্ষঃ  ইরানপন্থী মিলিশিয়া (হিজবুল্লাহ, হুথি, PMF, হাশদ আল-শাবি) ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়েছে (বিশেষ করে লেবানন ও ইয়েমেন থেকে)। যুক্তরাষ্ট্রকেও “সরাসরি লক্ষ্য” করার হুমকি দিয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ভূমিকাঃ  জাতিসংঘ (UN): জরুরি অধিবেশন ডেকেছে। 

যুদ্ধ থামানোর প্রস্তাব পাশ করলেও যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দিয়েছে। OPEC+: জ্বালানি সরবরাহ ঠিক রাখার চেষ্টা করছে; হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে চরম সংকট দেখা দিতে পারে।এই যুদ্ধে দুই দেশের কি ক্ষতি হতে পারে?  এই বিষয়ে কিছু বলার চেষ্টা করছি। ইরানের সম্ভাব্য ক্ষতিঃ যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল একত্রে ইরানের ফরডৌ, নাটানজ ও ইসফাহান পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোতে হামলা চালিয়েছে।এর ক্ষতির পরিমাণ হবে প্রায় এক দশকের উন্নয়ন বিনষ্ট ও পরমাণু অস্ত্র তৈরির স্বপ্ন বড়ভাবে পিছিয়ে পড়বে।  সামরিক পরিকাঠামোর ধ্বংসঃ বিমান ঘাঁটি, ক্ষেপণাস্ত্র সাইট, ড্রোন ফ্যাক্টরি ও IRGC কমান্ড সেন্টার ইসরায়েলের লক্ষ্যবস্তু। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হলে ভবিষ্যতে নিজেকে রক্ষা কঠিন হবে ইরানের । অর্থনৈতিক বিপর্যয়ঃ যুদ্ধ, নিষেধাজ্ঞা, এবং হরমুজ প্রণালী ঘিরে উত্তেজনা তেল রপ্তানিতে বাধা সৃষ্টি করছে।আয় কমে গেলে মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব এবং সামাজিক অস্থিরতা আরও বাড়বে।  

হরমুজ প্রণালী বন্ধের চাপে বিশ্ব ক্ষুব্ধ হতে পারে? ইরান যদি হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে, বিশ্ব তেল বাজারে চরম সংকট তৈরি হবে। এতে চীন, ভারতসহ মিত্ররাও ইরান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে। গণবিক্ষোভ ও অভ্যন্তরীণ চাপঃ যুদ্ধকালে সাধারণ জনগণের মৃত্যু, দারিদ্র্য ও সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণআন্দোলন হতে পারে।রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়বে; শাসকগোষ্ঠীর বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। এখন আলোচনা করছি এই যুদ্ধে ইসরায়েলের সম্ভাব্য ক্ষতি নিয়ে ।  সিভিলিয়ান এলাকায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলাঃ ইরান থেকে সরাসরি ও হিজবুল্লাহ-হুথি-মিলিশিয়া দ্বারা ইসরায়েল প্রতিনিয়ত ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন আক্রমণের শিকার। শহর, বিদ্যুৎকেন্দ্র, বিমানবন্দর, স্কুল লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছে। সামরিক ক্ষয়ক্ষতিঃ যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে সেনাবাহিনীর প্রাণহানি, সরঞ্জাম ক্ষতি ও মানসিক অবসাদ বাড়বে। হিজবুল্লাহর উত্তর সীমান্তে বড় হুমকি তৈরি হয়েছে। অর্থনৈতিক চাপঃ নিরাপত্তা ব্যয়, রিজার্ভ ক্ষয়, পর্যটন ও রপ্তানি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।যুদ্ধকালীন অর্থনীতি পরিচালনায় সরকারের ওপর চাপ। আন্তর্জাতিক সমালোচনা ও কূটনৈতিক চাপঃ মানবিক ক্ষয়ক্ষতির কারণে ইউরোপ ও জাতিসংঘ ইসরায়েলের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক আরও অবনতি হতে পারে। 

জনসাধারণের মানসিক স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ঝুঁকিঃ বিমান হামলার সাইরেন, বাঙ্কারে বসবাস, স্কুল বন্ধ থাকা — দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপ সৃষ্টি করবে। এই যুদ্ধ উভয় দেশের জন্যই লাভের চেয়ে ক্ষতির আশঙ্কা বেশি।আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন , এই যুদ্ধ ইরানের জন্য মূল ঝুঁকি: অর্থনীতি, পরমাণু কর্মসূচি, অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা।আর ইসরায়েলের জন্য ঝুঁকি: জননিরাপত্তা, দীর্ঘমেয়াদি সামরিক চাপ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অবনতি। সৌদি আরব,  আমিরাত ও  কাতার ঝুঁকি:ইরান প্রতিশোধমূলক হামলা চালাতে পারে — ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র বা হুথিদের মাধ্যমে।বিমানবন্দর, তেল পরিশোধনাগার, সামরিক ঘাঁটি হতে পারে লক্ষ্যবস্তু।অর্থনৈতিক ক্ষতি:যুদ্ধ হলে জ্বালানির দাম বাড়লেও নিরাপত্তাহীনতার কারণে বিনিয়োগ ও পর্যটনে ধস নামবে। লেবানন ঝুঁকি: হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সরাসরি লড়াই করছে — এর জবাবে ইসরায়েল লেবাননে বড় হামলা চালাতে পারে।যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে আরও মানবিক বিপর্যয় হবে; লেবানন ইতিমধ্যেই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর।

ইরাক ও সিরিয়ার  ক্ষতি: ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়া (PMF, IRGC) ঘাঁটিতে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল হামলা চালাচ্ছে।এতে বেসামরিক মানুষ মারা যাচ্ছে এবং অস্থিরতা বাড়ছে। পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া হুমকির মুখে।এখন  বিশ্বের শক্তিধর ও জ্বালানি-নির্ভর দেশসমূহ নিয়ে আলোচনা করছি , চীনের ক্ষতি:চীনের ৪০% তেল মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসে।হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে জ্বালানি সংকট ও মূল্যস্ফীতি হবে।চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ অঞ্চলেও অস্থিরতা বাড়বে। ভারতের ক্ষতি: ভারত তার ৮৫% জ্বালানি বিদেশ থেকে আমদানি করে — বেশিরভাগ মধ্যপ্রাচ্য থেকে। হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে তেল সরবরাহ বিঘ্নিত হবে → মূল্যবৃদ্ধি, ট্রেড ব্যালেন্স খারাপ, মুদ্রাস্ফীতি। উপসাগরীয় অঞ্চলে থাকা ৮০ লাখ ভারতীয় প্রবাসীও বিপদের মুখে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ক্ষতি: ইউক্রেন যুদ্ধের পর ইউরোপ বিকল্প জ্বালানির জন্য মধ্যপ্রাচ্যের দিকে ঝুঁকেছিল।এই যুদ্ধ সেই বিকল্প উৎসকেও ঝুঁকির মুখে ফেলছে।আবারও জ্বালানির দাম বাড়লে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিতে পারে। 

এই যুদ্ধে  রাশিয়ার ক্ষতি ও সুবিধা দুইই: জ্বালানির দাম বাড়লে রাশিয়া কিছু লাভ করতে পারে। তবে সিরিয়ায় রাশিয়ার ঘাঁটি রয়েছে — সেখানে ইসরায়েল হামলা চালালে রাশিয়ার স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং  বিশ্বব্যাপী জ্বালানি বাজারে বিপর্যয় নেমে আসবে বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মোট দিয়েছেন,  হরমুজ প্রণালী (Strait of Hormuz): দৈনিক প্রায় ২০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল এই পথ দিয়ে যায়।এটি বন্ধ হলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম $150+ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। বিশ্ব অর্থনীতি মন্দায় পড়বে। পরিশেষে বলতে চাই , এই যুদ্ধ শুধু ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়—এটি আঞ্চলিক নয়, বরং বৈশ্বিক পরিণতি বয়ে আনতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ, হরমুজ প্রণালীর ঝুঁকি, এবং তেলের বাজারে অস্থিরতা—সব মিলিয়ে একটি বিস্ফোরক বাস্তবতা তৈরি হয়েছে।

ইরান তার পারমাণবিক স্বপ্নে বড় ধাক্কা খেলেও, প্রতিশোধের আগুনে গোটা অঞ্চল জ্বলতে শুরু করেছে। আর ইসরায়েল, যতোই “জাতীয় নিরাপত্তা”র দোহাই দিক, প্রতিদিন বেড়ে চলা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ও অর্থনৈতিক চাপ তাদের ভেতর থেকে ক্ষয় করছে।

বিশ্বনেতারা যদি এখনই কার্যকর কূটনীতি ও গঠনমূলক সংলাপে না আসেন, তবে এই সংঘাত সহজেই পরিণত হতে পারে আরেকটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ-দুর্যোগে। বর্তমান বাস্তবতা আমাদের সামনে প্রশ্ন রাখে: আমরা কি একটি নতুন বিশ্বযুদ্ধের সূচনালগ্নে দাঁড়িয়ে আছি, নাকি এখনো সময় আছে মানবতা ও শান্তির দিকে ফিরে তাকানোর? 

লেখক: ড. আজিজুল আম্বিয়া, সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক। email:[email protected] 

মন্তব্য করুন