সমস্যার কথা তুলে ধরায় মালয়েশিয়ার মেডিসেরাম কোম্পানিতে কর্মরত এক বাংলাদেশির ভিসা বাতিল করা হয়েছে। এছাড়া আরও ৬০ জনের ভিসা বাতিলের হুমকি দিয়েছে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ।
বৃহস্পতিবার (১৫ মে) মালয়েশিয়ার নেগেরি সেম্বিলানের মেডিসেরাম এসডিএন বিএইচডির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাংলাদেশি কর্মী নাহিদ ইব্রাহিমকে ফোন করে জানান তার ওয়ার্ক পারমিট বাতিল করা হবে এবং তাকে বরখাস্ত করা হবে। এরপরই নাহিদকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে তার ওয়ার্ক পারমিট বাতিল করা হয়।
বাংলাদেশি শ্রমিকরা প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুলের কাছে খারাপ কাজের পরিবেশ নিয়ে কথা বলার একদিন পর কোম্পানি কর্তৃপক্ষ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন শ্রমিক জানিয়েছেন।
সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় চারদিনের সফরের সময় ১৪ মে উপদেষ্টা আসিফ নজরুল মেডিসেরামে কর্মরত বাংলাদেশি কর্মীদের সঙ্গে দেখা করেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশটি কীভাবে বাংলাদেশিদের জন্য শ্রমবাজার পুনরায় চালু করতে পারে এবং শ্রমিকদের সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করার জন্য মালয়েশিয়ার তিনজন মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন উপদেষ্টা।
বিদেশি নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগে মালয়েশিয়া গত বছরের মে মাসে বাংলাদেশিকর্মী নিয়োগ স্থগিত করে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মেডিসেরামের এক শ্রমিক বলেন, ‘নাহিদকে বরখাস্তের কথা শুনে আমরা হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম এবং প্রতিবাদ করেছিলাম। তারপর, কর্তৃপক্ষ জানায় যে তাদের কাছে আমাদের ৬০ জন শ্রমিকের একটি তালিকা আছে যাদের বরখাস্ত করা হবে।’
ভয়ে নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে এক বাংলাদেশিকর্মী বলেন, শুক্রবার (১৬ মে) প্রায় ২০০ শ্রমিক ধর্মঘট শুরু করেন।
উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের একান্ত সচিব মোঃ সারওয়ার আলমকে লেখা একটি ইমেইলে বরখাস্ত হওয়া শ্রমিক নাহিদ ইব্রাহিম লিখেছেন, ‘কোম্পানি আমার পিছু নিয়েছে এবং আমাদের উপদেষ্টার সঙ্গে শ্রম সমস্যা নিয়ে আমি যা বলেছি তা শুনেছে। হঠাৎ করেই তারা আমাকে অফিসে ডেকে বলেছে যে আমাকে বরখাস্ত করা হবে।’
ইমেইলটি কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশনেও পাঠানো হয়েছিল। নাহিদ তিন বছরের চুক্তিতে মালয়েশিয়ায় আসেন এবং এ বছরের আগস্টে তার ভিসার মেয়াদ শেষ হবে। স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়ায় আসতে নাহিদ পাঁচ লাখ টাকারও বেশি খরচ করেছেন। কোম্পানি তাকে নিয়মিত বেতন দেয়নি বলে এখনও ঋণগ্রস্ত আছেন।
নাহিদ লিখেছেন, দয়া করে কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা করুন। আমার এবং আমার পরিবারের পাশে থাকুন। নাহিদ জানিয়েছেন, উপদেষ্টার একান্ত সচিব বা হাইকমিশন কেউই তার ইমেইলের জবাব দেননি।
১৪ মে উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের কাছে দেওয়া এক চিঠি অনুসারে, বাংলাদেশি শ্রমিকরা মালয়েশিয়ায় চাকরির জন্য গ্রিনল্যান্ড নামের একটি নিয়োগকারী সংস্থাকে পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা করে দিয়েছিলেন।
চিঠিতে লেখা আছে, ফ্লাইটের আগে তারা শ্রমিকদের ক্যামেরার সামনে বলতে বাধ্য করেছিল যে তারা মাত্র ৭৮ হাজার টাকা করে দিয়েছেন।
চিঠিতে আরও লেখা আছে, দুই বছর ধরে মজুরি অনিয়মিত। কয়েক মাসে কোম্পানি বেতনের মাত্র অর্ধেক বা এক-তৃতীয়াংশ দেয়। তাদের পরিবারগুলো এখন আর্থিক সংকটে। তাদের ঋণ দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এখানে খাবার যোগানের জন্য কয়েক মাস তাদের বাংলাদেশ থেকে আরও টাকা ধার করতে হয়েছিল।
এমন পরিস্থিতিতে, তারা গত বছরের শেষের দিকে শ্রম আদালতে এবং পরে বাংলাদেশ হাইকমিশনে অভিযোগ দায়ের করেছিলেন, কিন্তু কোনো প্রতিকার পাননি।
এরপর তারা অ্যান্ডি হল নামের এক অভিবাসী অধিকারকর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি মেডিসিরামের কাছে বিষয়টি উত্থাপন করেন এবং তারপর তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে শ্রম সমস্যাগুলো নিরীক্ষা করান।
একপর্যায়ে, মেডিসিরাম নিয়মিত মজুরি প্রদান এবং নিয়োগ ফি হিসেবে ব্যয় করা মালয়েশিয়ান ২২ হাজার ৫০০ রিঙ্গিত পরিশোধ করতে সম্মত হয়। তারা অগ্রিম হিসেবে এক হাজার রিঙ্গিতও প্রদান করে, আশ্বাস দেয় যে আরও ৮৭৫ রিঙ্গিত ৩১ মে প্রদান করা হবে এবং বাকি অর্থ ১২ মাসের মধ্যে দেওয়া হবে। কিন্তু এই অর্থপ্রদান পরিকল্পনাটি তাদের জন্য অত্যন্ত কঠিন এবং তাদের পরিবারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ বলে কর্মীরা চিঠিতে লিখেছেন।
এর আগে, মেডিসিরাম কোনো নোটিশ ছাড়াই ৩৫ জন কর্মীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়েছিল। বর্তমানে ১৭০ জনের ওয়ার্ক পারমিট নবায়ন করা হয়নি। কেউ কেউ এক বছর ধরে ভিসা ছাড়াই আছেন, অন্যরা দুই বছর ধরে। কয়েক মাস আগে বৈধ ভিসা না থাকার কারণে চারজন শ্রমিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, কিন্তু কোম্পানি কোনো দায়িত্ব নেয়নি বলে চিঠিতে লেখা হয়েছে।
‘আমরা আগামী মাসের মধ্যে আমাদের ভিসা নবায়নের জন্য অনুরোধ করছি এবং এই সমস্ত সমস্যা সমাধানের জন্য আপনাদের আন্তরিকভাবে অনুরোধ করছি,’ চিঠিতে বলা হয়েছে।
অধ্যাপক আসিফ নজরুল মেডিসিরাম কোম্পানি প্রাঙ্গণে এই অভিবাসীদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তিনি তাদের পরামর্শ দিয়েছিলেন যে আলোচনার মাধ্যমে যে কোনো সমস্যা সমাধান করা হবে এবং এমন কিছু করবেন না যা তাদের বা কোম্পানির জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তিনি ইমেইল এবং ফোন নম্বরও দিয়েছিলেন যেন অভিবাসীরা সরাসরি তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।
এ বিষয়ে উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এবং তার একান্ত সচিব সারওয়ার আলমের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। কর্মীদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে মেডিসিরামের অফিস ফোনে যোগাযোগ করেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
মন্তব্য করুন