সোমবার, ০৪ নভেম্বর ২০২৪, ২০ কার্তিক ১৪৩১
জাতীয়প্রবাস বাংলাঅপরাধবাণিজ্যরাজনীতিসারাদেশমতামতস্বাস্থ্যফিচাররাজধানীপাঠকের কথাআবহাওয়াশিল্প-সাহিত্যগণমাধ্যমকৃষি ও প্রকৃতিইসলামবৌদ্ধহিন্দুখ্রিস্টানআইন-বিচারবিবিধআপন আলোয় উদ্ভাসিতবেসরকারি চাকুরিসরকারি চাকুরি Photo Video Archive

সোমবার, ০৪ নভেম্বর ২০২৪, ২০ কার্তিক ১৪৩১

প্রবাসে আমাদের দীনতা

ইয়াকুব আলী
  ২৯ অক্টোবর ২০২৪, ১১:৪৯

ধর্মীয় দৈন্যঃ বিদেশে আসার পর বাংলাদেশিরা সর্বপ্রথম যে জটিলতায় ভোগে সেটার না ধর্ম। বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে একমাত্র দেশ যার রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম কিন্তু সংস্কৃতি বাঙালি। বাংলাদেশিরা ধর্মের সাথে সংস্কৃতির এমন বৈপরিত্য একইসাথে ধারণ করে আসছে অনেককাল ধরেই সেটা আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু নয়। বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশিরা জাতি হিসেবে বেশ নবীনই বলা চলে। তার আগেই প্রতিবেশি দেশ দুটি থেকে মানুষ বিদেশে এসেছে এবং নিজের দেশের অস্তিত্ব জানান দিয়েছে। দেখতে মোটামুটি একই শারীরিক গঠনের হওয়াতে বাংলাদেশিদেরকে রীতিমত যুদ্ধ করেই বাংলাদেশি পরিচয়টা দিতে হয়। যাইহোক বাংলাদেশি মুসলমানদের এখানে আসার পর নামায এবং বাকী ধর্মীয় রীতিনীতিগুলো পালনের জন্য বিদ্যমান ধর্মীয় ব্যাবস্থার উপরই নির্ভর করতে হয়। 

তাই এরা আমাদের উপমহাদেশের আরেক বৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের মানুষের সাথে দ্রুতই মিশে যায়। এবং হিন্দি সিরিয়াল দেখে দেখে হিন্দি রপ্ত থাকাতে তাদের সাথে কথাবার্তায়ও সমস্যা হয় না। এমনকি তারা অনেক টাকা খরচ করে ছেলেমেয়েদেরকে মুসলিম প্রাইভেট স্কুলেও পড়তে পাঠায় যদিও তারা বেশিরভাগই ট্যাক্স ফাকি দেয় আমরা সে আলোচনায় যেতে চাচ্ছি না। এতেকরে কোমলমতি ছেলে মেয়েদের মধ্যে খুব ছোট থেকেই ধর্ম বিষয়ে বেশ কট্টর ধারণা তৈরি হয়। আমার পরিচিত একটি পরিবারের দুজন সন্তানই মুসলিম প্রাইভেট স্কুলে যায়। তাদের মধ্যে ছোটটিকে নিয়ে সেই পরিবারের সবাই গর্ব করে এই বলে যে সে অনেক বুদ্ধিমতি এবং মেধাবী। 

সেই মেয়েটা একদিন আমাদের বাসায় এসে একটা অস্ট্রেলিয়ান চ্যানেলের প্রোগ্রামে একজন অস্ট্রেলিয়ান ভদ্রমহিলার পোশাক পরিচ্ছদ দেখে আমাকে প্রশ্ন করলেন, উনি কেন হিজাব পরেন নাই? অন্য একদিন সেই একই শিশু পূজা দেখতে যাওয়া নিয়ে তার অবস্থান এইভাবে ব্যক্ত করলো যে পূজাতো মুসলমানদের জন্য হারাম। একেবারে শৈশব থেকেই এমন ধারণা নিয়ে যে প্রজন্ম বেড়ে উঠবে তারা আর যাইহোক পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠতে পারবে না। 

পোশাকি দৈন্যঃ পৃথিবীর বুকে প্রত্যকে জাতিরই নিজস্ব ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি আছে আর সেগুলোর প্রতিফলন রয়েছে তাদের পোশাক পরিচ্ছদে। কিন্তু আকাশ সংস্কৃতির প্রকোপে বাংলাদেশিরা যেখানে নিজের দেশে বসবাস করেই নিজেরদের পোশাক পরিচ্ছদকে ক্ষ্যাত মনে করে সেখানে এই বিদেশ বিভুয়ে সেটা আরো প্রকট আকার ধারণ করে। বেশ কিছু কারণে বাংলাদেশিদের পোশাক পরিচ্ছদ থেকে বাংলাদেশি সংস্কৃতির আবহ হারিয়ে যেয়ে বিজাতীয় সংস্কৃতি স্থান করে নিয়েছে। প্রথমত বিদেশের মাটিতে দেশিয় পোশাকের অপ্রতুলতা। 

এখানে বাংলাদেশিদের যেসকল ফ্যাশন হাউসগুলো আছে তারা সুন্দর সুন্দর বাংলা  নাম নিয়ে ভারতীয়, পাকিস্তানি, ইরানি ও আফগানি পোশাকের রমরমা ব্যাবসা করে যাচ্ছে। কিছু ফ্যাশন হাউস দেশিয় পোশাক আমদানি করে ব্যাবসা করার চেষ্টা করেও সেইভাবে সফলকাম হতে পারে নাই। তবুও হাতেগোনা দু একটি ফ্যাশন হাউস চেষ্টাটা চালিয়ে যাচ্ছে এবং ধীরে ধীরে সফলতা পেতে শুরু করেছে। বিদেশি পোশাকগুলোর জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ হচ্ছে আমরা আমাদের দেশীয় পোশাক পরিধান করাকে তথাকথিত স্মার্টনেস হিসেবে দেখি না। এমনকি বিদেশি পোশাকের তুলনায় দাম একটু কম হওয়াতে নিজের প্রেস্টিজ খাটো হওয়ার ভয়ে আমরা সেগুলো পরতে চাই না। এভাবে বাবা-মায়ের কাছ থেকে পরবর্তি প্রজন্মও দেশীয় সাজ-পোশাকের প্রতি অবজ্ঞা নিয়ে বেড়ে উঠছে। 

সাংস্কৃতিক দৈন্যঃ বিদেশ বিভুয়ে আসার পর সবচেয়ে বড় যে জটিলতায় বাংলাদেশিরা ভুগেন সেটা হল সাংস্কৃতিক দৈন্য। বাংলাদেশের পঞ্জিকা বর্ষের বারো মাসে তের পার্বন পালন এখানে সম্ভব হয় না ভৌগলিক এবং জলবায়ুগত ভিন্নতার কারণে। তবুও অন্নপ্রাশন, হাতেখড়ি, পহেলা বৈশাখ, শহীদ দিবস, স্বাধীনতা দিবস, শোক দিবস এবং বিজয় দিবসের মত উৎসবগুলো শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতায়ই সীমাবদ্ধ। এবং বাংলাদেশিদের একাধিক গ্রুপ এবং উপগ্রুপ থাকার কারণে এই অনুষ্ঠানগুলোও তার পরিপূর্ণ জাকজমক এবং জৌলুস হারিয়ে ফেলে। 

এছাড়া ব্যাক্তি পর্যায়ে জন্মদিন, বিবাহ বার্ষিকি, বেবি শাওয়ারের মত যে অনুষ্ঠানগুলো করা হয় সেখানে বাঙালি ঐতিহ্যের মিশেল খুব সামান্যই খুজে পাওয়া যায়। অস্ট্রেলিয়াতে জন্ম নেয়া ও বেড়ে ওঠা দ্বিতীয় প্রজন্ম তাই বেড়ে উঠছে একেবারেই শিকড়হীন পরগাছা হিসেবে। এখানে অভিবাবকরা বাংলাদেশের অভিবাবকদের মত তাদের পরবর্তি প্রজন্মকে শুধু লেখাপড়াতেই ভালো করানোর জন্ম আদাজল খেয়ে লেগে আছে। তাই এখানেও প্রাইভেট টিউশনি এবং কোচিং ব্যাবসার রমরমা। যার ফলে ছেলেমেয়েরা পুঁথিগত বিদ্যায় পারদর্শি হচ্ছে কিন্তু কমিউনিকেশন স্কিলে ল্যাগ থাকার কারণে স্থানীয়দের সাথে প্রতিযোগীতায় পিছিয়ে পড়ছে। 

তারা খুব সামান্য সময়ই দিতে পারে সিলেবাসের বাইরের সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে। ফলে তারা বাংলাদেশি সংস্কৃতির চর্চাতো অনেক দুরের ব্যাপার তারা অস্ট্রেলিয় সংস্কৃতির সাথেও খুব বেশি একটা পরিচিত হচ্ছে না। আর এই ছুঁচো দৌড়ে কে কার আগে পৌঁছাবে সেই প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হয়ে শিশুদের মানসিক বিকাশও বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। তারা হচ্ছে শারীরিক এবং মানসিকভাবে অক্ষম এক প্রজন্ম। ফলে এই প্রজন্ম একদিকে যেমন অস্ট্রেলিয় হিসেবে বেড়ে উঠছে না অপরদিকে শেকড়হীন কচুরিপানার ন্যায় ভাসমান প্রজন্ম হিসেবেই থেকে যাচ্ছে। হাতেগোনা কিছু অভিবাবক এর ব্যতিক্রম এবং তাদের বাচ্চারা দুনিয়ার সকল খোজ খবর রেখে, অস্ট্রেলিয় সংস্কৃতি ও বাংলাদেশি সংস্কৃতির মিশেলে এক অল রাউন্ডার প্রজন্ম হিসেবে বেড়ে উঠছে যেটা হওয়ার কথা ছিল প্রত্যেকটা শিশুর ক্ষেত্রে।  

ভাষাগত দৈন্যঃ বাংলাদেশিরা পৃথিবীর বুকে একমাত্র জাতি যারা ভাষার দাবী প্রতিষ্ঠা করার জন্য দেহের তাজা রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করেছে এবং যার মধ্যে নিহিত ছিল বাংলাদেশি জাতিয়তাবোধের সুপ্ত বীজ। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে গঠিত একটি রাষ্ট্র পাকিস্তান গঠনের কয়েক বছরের মধ্যেই জাতীয়তাবোধের পার্থক্য মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। যার প্রথম ধাপ ছিল ভাষার দাবী প্রতিষ্ঠা করা। যার স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর UNESCO বাংলাদেশিদের ভাষা সংগ্রামের ইতিহাসকে সম্মান জানিয়ে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সম্মান প্রদান করে এবং বিশ্বব্যাপি যথাযোগ্য ভাবগাম্ভির্য ও মর্যাদায় সেটা পালিত হয়ে আসছে। ভাষা কেন একটি জাতি থেকে অন্য জাতিকে আলাদা করে দেয় তার প্রমাণ পাওয়া যায় বিদেশে আসলে। 

আমরা সবাই জানি ভারত-পাকিস্তান চির বৈরি রাষ্ট্র। কিন্তু যেহেতু তাদের কথ্য ভাষা প্রায় একই তাই তাদের মধ্যে খুব সহজেই যোগাযোগ তৈরি হয়ে যায়। কেউ আলাদা করে যদি বলে না দেয় যে উনি ভারতীয় আর উনি পাকিস্তানি তাহলে বাইরে থেকে বুঝা আসলেই অনেক কষ্টসাধ্য। এমনকি এই দুটি রাষ্ট্রের জন্ম একই সালের এক দিন শুধু এদিক আর ওদিকে হওয়ায় তাদের জাতিয়তাবোধেরও তেমন কোন ব্যাবধান নেই। পাকিস্তানিরা এমন একটা ভাব করে যেন বাংলাদেশকে ১৯৭১ সালে ছোটভাই হিসেবে মাফ করে দিয়েছে আর ভারতীয়রা মনেকরে বাংলাদেশ আসলে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ করে নাই, আসল যুদ্ধটা তারাই করে বাংলাদেশকে স্বাধীনতাটা উপহার হিসেবে দিয়েছে। তাই তাদের মধ্যে গলায় গলায় পিরিত। দুজন পাকিস্তানি-ভারতীয় কথা বললে সেখানে একজন বাঙালি থাকলে মোটেও গ্রাহ্য করা হয় না। আর বাংলাদেশিরা কেন হিন্দি-উর্দু জানে না সেটা নিয়েও তাদের মধ্যে এক ধরণের বিস্ময় কাজ করে। কিন্তু তারা জানেই না বাংলাদেশ রাষ্ট্রটার জন্মই হয়েছিল ভাষাগত ব্যাবধানের শুরু দিয়ে। 

বাংলাদেশে এখন আকাশ সংস্কৃতির গ্রাসের ফলে হিন্দি বলাটাকে স্মার্টনেস হিসেবে দেখা হয় তাই এদেশে আসা নতুন প্রজন্মও নিজেদেরকে আরো বেশি স্মার্ট প্রমাণ করার জন্য ভারতীয় বা পাকিস্তানিদের সাথে হিন্দি-উর্দুতে কথা বলা শুরু করে। আমার ধারণা এটা দেখে ভারতীয় এবং পাকিস্তানিরা মনেমনে হাসে। যাইহোক যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এবং এখানকার পরিবেশে নিজেদেরকে খাপ খাইয়ে নিতে ইংরেজির বিকল্প নেই কিন্তু এর বাইরে বাংলাদেশিরা যদি নিজেদের পরিবারে বাংলার চর্চাটা ধরে রাখে তাহলে অন্তত বাংলাদেশি জাতীয়তাবোধের প্রথম লক্ষ্যটা পূরণ হয়। কিন্তু তাদের বাচ্চারা বাংলা বলতে পারে না এটা নিয়ে বেশির ভাগ বাংলাদেশি অভিভাবককেই দেখা যায় গর্ববোধ করতে এমনকি কিছু অতি শিক্ষিত অভিবাবককে দেখা যায় গর্ব করে বলতে যে তার বাচ্চা ইংরেজির বাইরে আরো একটা ভাষা জানে সেটা হচ্ছে হিন্দি।

মানসিক দৈন্যঃ মানুষের মন সৃষ্টিকর্তার এক আজব সৃষ্টি। আসলে এটাই সৃষ্টির অন্য সকল সৃষ্টিকুল থেকে মানুষকে আলাদা করেছে, করেছে উন্নত।  কিন্তু আবার এই মানুষই এটার খারাপ ব্যবহারের ফলে অন্য সৃষ্টিকুল থেকে নিজেদেরকে হীন প্রমাণ করছে।  তবে মানসিকতার বিকাশের জন্য একটা সুষ্ঠ স্বাভাবিক পরিবেশের দরকার হয় যাতেকরে মানুষের মধ্যে স্বাভাবিক বিচার বুদ্ধি তৈরি হতে পারে। কিন্তু আমরা বাংলাদেশের শিক্ষিত প্রজাতির মানুষগুলো এক আজব শিক্ষা পেয়ে বেড়ে উঠি।  যেখানে প্রতিযোগিতাটায় মুখ্য। জীবনে আর্থিকভাবে যে যত বেশি লাভবান হয় তাকে তত বেশি সফল বলা হয়।  আর আমরা আরো একটু বেশি সফলতার আসায় বিদেশে পাড়ি জমায়।  

এখানে এসে নিজের মূল্যবোধ, সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা আমরা একে একে সবই ত্যাগ করতে থাকি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও সেই পথে পরিচালনা করি।  আর যেহেতু মূল্যবোধগুলো সবই মানসিক ব্যাপার তাই সেগুলো ত্যাগ করতেও আমাদের বেশি সময় লাগে না।  আর রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং ব্যবসায়িক নেতৃবৃন্দ যাদের হাত ধরে আমাদের মূল্যবোধগুলো টিকে থাকার কথা ছিল তারা ব্যস্ত নিজস্ব ব্যক্তি স্বার্থ উদ্ধারে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ আদর্শের কথা বলে লোক দেখানো মূল্যবোধের পরিচয় দিয়ে নিজের স্বার্থ সিদ্ধিতে ব্যস্ত। সাংস্কৃতিক নেতৃবৃন্দ যাদের হাতে মূল্যবোধের মাপকাঠিটা আসলে থাকার কথা ছিল তারাও নিজের ব্যক্তি স্বার্থ উদ্ধারে বিভিন্ন ছাতার তলে ভিড়ে যান। আর ব্যবসায়ীরা আরো এক কাঠি সরেস, তারা দেশ থেকে নতুন আসা মানুষগুলোকে বিভিন্নভাবে শোষণ করতে থাকেন।  

এ যেন বাংলাদেশেরই সামগ্রিক প্রতিচ্ছবির খন্ড রূপ। কিন্তু খারাপ ব্যাপার হচ্ছে ষোল কোটির দেশে এগুলো তেমন চোখে বাধে না কিন্তু এখানে এগুলো খুবই দৃষ্টি কটু দেখায়।  

মন্তব্য করুন