গত ১০ জুলাই ২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পরপরই দেশের পাঁচটি ভিন্ন জেলায় পাঁচ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার সংবাদ এসেছে যারা পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছিল। বয়সের কাঁচা সময়ের এই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কেবল ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, এটি সমাজ, শিক্ষা ব্যবস্থা এবং অভিভাবকত্বের ওপর একটি কঠিন প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দেয়, এই মৃত্যুর দায় আসলে কার?
একই ফলাফলের দিনে কেউ নেচে উঠছে, কেউ চিরতরে থেমে যাচ্ছে নিশ্চয়ই এ এক নির্মম বৈপরীত্য । এবার এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিনে দেশে হাজারো শিক্ষার্থী আনন্দে আত্মহারা হয়েছে। কারও প্রথম বিভাগ, কারও গোল্ডেন এ+, কেউ বাবা-মাকে ফোন দিয়ে কেঁদেছে খুশিতে। কিন্তু সেই একই দিনে পাঁচটি কচি প্রাণ চিরতরে নিভে গেছে, শুধু একটি শব্দের কারণে যার নাম ফেল।
এটাই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার ভয়াবহ দ্বিচিত্র বাস্তবতা। যেখানে পাস মানে বাঁচা, আর ফেল মানে মরে যাওয়া। অথচ পরীক্ষা কেবল একটি মূল্যায়ন, জীবনের শেষ কথা নয়। কেউ একবার ফেল করলেই সে কীভাবে নিজেকে অপ্রয়োজনীয় ভাবতে শুরু করে। তা বোঝায় আমাদের সমাজ, পরিবার, শিক্ষাব্যবস্থার কোথাও ভয়ানক এক শূন্যতা আছে।
আমরা একটা এমন শিক্ষাব্যবস্থা দাঁড় করিয়েছি, যেখানে পাশ মানেই সম্মান, উৎসব, মিষ্টি বিতরণ আর ফেল মানেই অপমান, অবহেলা, কিংবা আত্মহত্যার মতো চূড়ান্ত পরিণতি। অথচ এ দুটোই একই পদ্ধতির ফল। একই পাঠ্যক্রম, একই প্রশ্নপত্র, একই পদ্ধতিতে পরীক্ষা। তাহলে কেন একজন ঘরে ফিরে মা-বাবার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে খুশিতে, আরেকজন ফ্যানের সঙ্গে দড়ি বেঁধে চিরতরে চলে যায়?
এই পরিস্থিতি আমাদের কেবল মর্মাহত নয়, নির্বাক করে দেয়। একই দিন কারও স্কুল প্রাঙ্গণে বেজে উঠেছে ঢোল, আর কারও উঠোনে নেমেছে লাশ। এই ব্যবস্থায় আমরা কী সত্যিই পাস করছি? এই নির্মম বৈপরীত্য দূর করতে না পারলে আমাদের সামনে আরও অনেক এমন মর্মান্তিক দিন অপেক্ষা করে থাকবে।
আমাদের সমাজে পরীক্ষার ফলাফলকে ঘিরে যে মনস্তাত্ত্বিক চাহিদা গড়ে তোলা হয়, তার একটি রূঢ় বাস্তবতা। ফেল করেছো মানে তুমি ব্যর্থ, এই সরলীকৃত অথচ নির্মম বার্তাটি শিশুদের মানসজগতে গেঁথে দেওয়া হয় ছোটবেলা থেকেই। এমনকি কোনো কোনো পরিবারে ফেল মানেই অপমান, গালাগাল, শাস্তি, কখনো কখনো গৃহে অস্বীকৃতি।
এই শিক্ষাব্যবস্থায় ফেল শব্দটি একটি সামাজিক মৃত্যু। অথচ একটি পরীক্ষা একটি শিশুর মেধা, সামর্থ্য, কিংবা ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারে না। প্রাথমিকভাবে রাষ্ট্র যদি ব্যর্থ হয় শিক্ষাকে কেবল পাস-ফেল আর জিপিএতে সীমাবদ্ধ না রেখে জ্ঞান, দক্ষতা, ও নৈতিকতার বিস্তৃত ছকে রূপ দিতে হবে।তাহলে এই মৃত্যুগুলোর দায় থেকে কি সে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারে।
আরও এক গুরুত্বপূর্ণ দায় বর্তায় আমাদের গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর। ফলাফলের দিন যে রকম ফলের শিরোনামে ফেল শব্দটিকে আতঙ্কের মতো উপস্থাপন করা হয়, তাতে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি হয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে। কেউ কেউ হয়তো ভাবে, সবাই জানবে আমি ফেল করেছি —এই সামাজিক লজ্জা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যাকে একমাত্র উপায় মনে করে।
সরকারি পর্যায়েও এই ধাক্কা সামাল দেওয়ার মতো সাইকো-সোশ্যাল সাপোর্ট বা কাউন্সেলিং সুবিধা নেই বললেই চলে। স্কুলে-কলে কোনো প্রশিক্ষিত পরামর্শদাতা নেই, নেই কোনো জরুরি হেল্পলাইন যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা হতাশার সময়ে কথা বলতে পারে।
ফলাফল ঘোষণার দিন কিংবা পরবর্তী সপ্তাহে যদি প্রতিটি স্কুলে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা কর্মসূচি নেওয়া হতো, তাহলে হয়তো এই তিনটি জীবন আজও বেঁচে থাকতো। এই প্রেক্ষাপটে আমাদের বড় করে ভাবার সময় এসেছে। একটি শিশুর আত্মহত্যা কেবল তার ব্যক্তিগত হার না, বরং একটি রাষ্ট্রব্যবস্থার, একটি শিক্ষানীতির, একটি সমাজ-মনস্তত্ত্বের ভয়াবহ ব্যর্থতা।
এই দায় কার? প্রথমে দেখা যায় এই দায় রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র এখনও শিক্ষা ব্যবস্থায় নম্বরতন্ত্রের চেয়ে মানুষ তৈরির কথা ভাবতে শেখেনি।রাষ্ট্র কবে ফেল করা শিক্ষার্থীর মানসিক সুরক্ষা নিয়ে ভাবলো? দেশের অধিকাংশ স্কুলে নেই কোনও প্রশিক্ষিত কাউন্সেলর। নেই পরীক্ষা-পরবর্তী মানসিক সহায়তা। নেই বিকল্প শিক্ষার পথ বা দ্বিতীয় সুযোগের বিশ্বাসযোগ্য নিশ্চয়তা। অথচ ইউরোপ-আমেরিকাসহ অনেক উন্নত দেশে একজন শিক্ষার্থী একবার পরীক্ষায় ব্যর্থ হলেও বিকল্প পথ ধরে নিজেকে গড়ে তুলতে পারে। সেখানে ফেল মানে শেষ নয়, একটি নতুন শুরু।
রাষ্ট্রের মাধ্যমে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে পাস-ফেল নির্ভরতা থেকে বের করে আনা জরুরি। প্রয়োজন বিকল্প মূল্যায়ন পদ্ধতির, যেখানে জ্ঞান, দক্ষতা, সৃজনশীলতা, ও সহানুভূতির ভিত্তিতে একজন শিক্ষার্থীর সক্ষমতা মূল্যায়ন হবে। প্রতিটি স্কুলে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। ফলাফল প্রকাশের দিনে ফেল করা শিক্ষার্থীর পাশে দাঁড়াতে হবে সবচেয়ে বেশি।
দ্বিতীয়ত এই দায় পরিবারের, যারা সন্তানের ব্যর্থতাকে ভালোবাসার চেয়ে লজ্জার কারণ হিসেবে দেখেন। এখানে অনেক অভিভাবকদের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। সন্তান শিক্ষার্থী, যন্ত্র নয়। সন্তানের দুর্বলতা, ভয়, কিংবা অসফলতা, এসবই পারিবারিক সমর্থনের মাধ্যমে কাটিয়ে ওঠার কথা। কিন্তু যখন মা-বাবা নিজের অপূর্ণ বাসনা সন্তান দিয়ে পূরণ করতে চান, কিংবা সামাজিক লজ্জা থেকে বাঁচতে সন্তানের ফলাফলকে আত্মমর্যাদার মাপকাঠি বানিয়ে ফেলেন, তখন শিশু কেবল একজন পরীক্ষার্থী নয়, বরং পরিবারের মানসম্মানের ভার বহনকারী এক করুণ কাঁধে পরিণত হয়। তাতে যদি সে একবার হোঁচট খায়, তখন আত্মহত্যাই হয়ে ওঠে মুক্তির পথ যদিও সেটি শুধুই এক চরম বোকামি।
এরপর এই দায় শিক্ষকের, যিনি নম্বর দিয়ে ছাত্রকে মেপে ফেলেন।আর স্কুল-কলেজে শিক্ষকরা অনেক সময় ফলাফলের ভিত্তিতে ছাত্রদের সঙ্গে পার্থক্য করেন, পেছনের বেঞ্চে বসা ছাত্রদের নিয়ে অনুশোচনার হাসি তোলেন। শিক্ষার্থীর পরিচিতি তখন আর ব্যক্তি নয়, হয়ে দাঁড়ায় একটি নম্বর।
সর্বোপরি এই দায় সমাজের, যে ফেলকে অপমান মনে করে। আমাদের এখানে ফেল মানে সামাজিক মৃত্যুদণ্ড। পাড়া-প্রতিবেশীরা প্রশ্ন করে, গাল দেয়, দৃষ্টিতে অপমান ঝরে, অমুকের ছেলে গোল্ডেন এ+ পায়, আর তোর ছেলে ফেল করে। একজন শিক্ষার্থী তখন নিজেকে সমাজের জন্য 'বিব্রতকর ব্যর্থতা' মনে করতে শুরু করে। কারো কারো আত্মবিশ্বাস ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে আমাদের আত্মপ্রশ্ন করা উচিত একটি শব্দ, একটি পরীক্ষার ফল, কীভাবে একটি শিশুকে আত্মহত্যার মতো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছে দেয়?
সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের সামাজিক মনোভাব বদলাতে হবে। ফেল করেছো মানে তুমি শেষ, এই বিশ্বাস যতদিন সমাজ থেকে মুছে না যায়, ততদিন ফেল শব্দটা থেকে যাবে এক ধরনের মানসিক মৃত্যুর ঘোষণার মতোই। এর দায় কেবল ওই শিক্ষার্থীর নয়, বরং পুরো সমাজের। এবং এই দায় এড়ানো যায় না।
যতদিন পর্যন্ত আমরা শিক্ষা ব্যবস্থাকে জীবনের মানে বোঝার জন্য নয়, কেবল প্রতিযোগিতার মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করব ততদিন এমন মৃত্যুগুলো বারবারই আমাদের সামনে আয়নার মতো দাঁড়াবে। সময় এসেছে এই আয়নার দিকে চেয়ে নিজের মুখ দেখার। প্রশ্নটা জোরে করে তোলার: ফেল করলো সে, মরলোও সে, কিন্তু ব্যর্থ আমরা সবাই। এটা শুধু শিক্ষার্থীদের ব্যর্থতা নয় এটা আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ এবং মানবিকতার সম্মিলিত ব্যর্থতা।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।
[email protected]
মন্তব্য করুন