আজকের বিশ্বে রাষ্ট্র পরিচালনার প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো—কীভাবে একটি রাষ্ট্র তার জনগণকে সাম্য, নিরাপত্তা ও উন্নয়নের নিশ্চয়তা দিতে পারে, বিশেষ করে যখন সেই রাষ্ট্র ধর্ম, জাতি, ভাষা ও শ্রেণি বিভক্ত এক জটিল সমাজ কাঠামোর ভেতর অবস্থিত। বাংলাদেশ এই প্রশ্নের এক সংকটকালীন মুহূর্তে এসে দাঁড়িয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সমাজে ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থান, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাহীনতা, হুজুরদের রাষ্ট্রীয় নীতিতে প্রবেশের আকাঙ্ক্ষা এবং একটি ইসলামিক রাষ্ট্র কায়েমের আহ্বান ক্রমেই উচ্চকিত হচ্ছে। এমনকি অনেক ইসলামপন্থী দল ও ব্যক্তিত্ব সরাসরি দাবি করছেন, “বাংলাদেশকে একটি ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত করাই মুসলমানদের বহুদিনের দাবি।”
এই প্রেক্ষাপটে আমরা যদি সুদানের অভিজ্ঞতার দিকে তাকাই, তবে বিষয়টি আরও গভীরভাবে অনুধাবন করা সম্ভব হয়। শতকরা ৯৭ শতাংশ মুসলমানের দেশ সুদান—১৯৮৯ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ইসলামী আইনের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে। একনায়ক শাসনের ছত্রছায়ায় শরিয়াহ আইন বাস্তবায়ন করা হয়। ধর্মীয় পরিচয়ই রাষ্ট্রীয় আইনের মূল উৎসে পরিণত হয়। কিন্তু দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে সেই ধর্মভিত্তিক শাসনব্যবস্থা বিচারহীনতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, সংখ্যালঘু নিপীড়ন, দারিদ্র্য, শিক্ষার পশ্চাদপসরণ ও আন্তর্জাতিক একঘরে হয়ে পড়া—এইসব সংকটে নিমজ্জিত করে দেশটিকে।
এই অবস্থার বিরুদ্ধে সুদানে জন্ম নেয় “পিপলস লিবারেশন মুভমেন্ট (SPLM)” নামে একটি বিপ্লবী সংগঠন, যারা শুরু থেকেই ধর্মনিরপেক্ষতা ও নাগরিক অধিকারের পক্ষে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল। অবশেষে ২০২০ সালে একটি ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার ঘোষণা দেওয়া হয়। ঘোষণা করা হয়—“ধর্ম ও রাষ্ট্রকে পৃথক করে একটি গণতান্ত্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র গড়াই হবে ভবিষ্যতের লক্ষ্য।”
এই সিদ্ধান্তের ফলাফলও ছিল তাৎপর্যপূর্ণ:
• আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বেড়ে যায়
• বিদেশি বিনিয়োগের ঢল নামে
• নাগরিকদের বিদেশ ভ্রমণে সুযোগ বৃদ্ধি পায়
• স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বড় ধরনের অগ্রগতি ঘটে
• GDP প্রবৃদ্ধি ৫ বছরে ১০.৭২% হয়
• মাথাপিছু আয় মাত্র ৫ বছরে তিনগুণ হয়ে দাঁড়ায় $১৬৮৭
অথচ বাংলাদেশের অবস্থা ঠিক বিপরীত দিকে যাচ্ছে। ধর্মীয় রাজনীতির পুনরুত্থান, মৌলবাদী গোষ্ঠীর উগ্র রূপ, সংখ্যালঘু নিপীড়ন, ওয়াজ মাহফিলে উসকানিমূলক বক্তব্য, মসজিদ ও মাদ্রাসাভিত্তিক উগ্র রাজনীতি রাষ্ট্রের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও বৈচিত্র্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিনিয়োগ কমে যাওয়া, আন্তর্জাতিক ভিসা নীতিতে কঠোরতা, এবং রাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতায় ধস।
প্রশ্ন হচ্ছে, যদি এই ধারা চলতে থাকে এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা একসময় ধর্মীয় গোষ্ঠীর হাতে চলে যায়, তবে কি বাংলাদেশ সুদানের পূর্ববর্তী ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হবে না?
একটি রাষ্ট্র যখন শরিয়াহ নামের আপাতবৈধ কাঠামোর মাধ্যমে মৌলিক মানবিক অধিকার ক্ষুন্ন করে, তখন তা আত্মঘাতী রূপ ধারণ করে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ধর্ম যখন রাষ্ট্রকে দখল করে, তখন ধর্ম নয়—রাষ্ট্রই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ ধর্ম এক নিগূঢ় ব্যক্তিগত অনুশীলনের জায়গা, আর রাষ্ট্র একটি বহু বৈচিত্র্য ধারণকারী কাঠামো। এই দুইকে জোর করে একত্র করলে অবশেষে দমন, দুর্বলতা ও দ্বন্দ্ব অনিবার্য হয়ে ওঠে।
একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র মানেই ধর্মহীন রাষ্ট্র নয়। বরং সেটি এমন একটি কাঠামো, যেখানে সকল ধর্মের মানুষ সমান অধিকার ও মর্যাদার সঙ্গে বসবাস করতে পারে। যেখানে রাষ্ট্র কোনও নির্দিষ্ট ধর্মের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে অন্যদের বঞ্চিত করে না। রাষ্ট্রের কাজ মানুষের ধর্ম রক্ষা করা নয়—মানবিক অধিকার রক্ষা করা।
আজ বাংলাদেশে প্রয়োজন একটি সাহসী ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তা, যেখানে ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি সম্মান থাকবে, কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকবে যুক্তি, ন্যায়বিচার এবং মানবিকতা। সুদান আমাদের দেখিয়েছে, কীভাবে একটি দেশ ভুল পথে গিয়ে আবার নিজেকে সংশোধন করতে পারে। আমাদের কাছে সেই সুযোগ এখনো রয়েছে—তবে সময় খুব বেশি নেই।
⸻
শেষ কথা:
রাষ্ট্রের ভিত্তি হওয়া উচিত ন্যায়, সমতা ও মানবিক মর্যাদা। ধর্ম হোক ব্যক্তির আত্মিক অনুশীলন, রাষ্ট্র হোক সকল নাগরিকের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। নয়তো সুদানের অতীত একদিন আমাদের ভবিষ্যত হয়ে দাঁড়াবে।
⸻
ফকির চাঁদ:
সামাজিক বিশ্লেষক ও রাষ্ট্রভাবনাবিষয়ক গবেষক, জাপান প্রবাসী।
মন্তব্য করুন