রবিবার, ২২ জুন ২০২৫, ৮ আষাঢ় ১৪৩২
জাতীয়প্রবাস বাংলাঅপরাধবাণিজ্যরাজনীতিঅন্যান্যসারাদেশমতামতস্বাস্থ্যফিচাররাজধানীপাঠকের কথাআবহাওয়াশিল্প-সাহিত্যগণমাধ্যমকৃষি ও প্রকৃতিইসলামবৌদ্ধহিন্দুখ্রিস্টানআইন-বিচারবিবিধআপন আলোয় উদ্ভাসিতবেসরকারি চাকুরিসরকারি চাকুরি Photo Video Archive

রবিবার, ২২ জুন ২০২৫, ৮ আষাঢ় ১৪৩২

ইরানের গোয়েন্দা সক্ষমতার ব্যাপক ক্ষতি

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
  ২২ জুন ২০২৫, ১৩:৩৮

ইরানের ওপর ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলার সূচনা আকাশপথ ধরে নয়, এর শুরুটা হয়েছিল স্থলপথ ধরেই। হামলা শুরু হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন প্রতিবেদন অন্তত সেরকমই ইঙ্গিত করছে। এই হামলার জন্য দীর্ঘদিন ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছিল ইসরায়েল। প্রস্তুতির ভিত্তি ছিল গভীর গোয়েন্দা তথ্য ও ইরানে অপারেশনাল অনুপ্রবেশ।

বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরানের কর্মকর্তারা সে দেশের নিরাপত্তা বাহিনীতে ইসরায়েলি অনুপ্রবেশের বিষয়ে অবশ্য আগেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। তবে এই পুরো ঘটনায় ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের ভূমিকা কতটা ছিল, তা অনুমান করা সহজ নয়। তাছাড়া ইসরায়েল সাধারণত মোসাদের কার্যক্রম নিয়ে খুব একটা মন্তব্য করে না।

আবার এমনটাও হতে পারে যে ইরানের বিরুদ্ধে চালানো কর্মকাণ্ডের সঙ্গে অন্য গোয়েন্দা সংস্থাও জড়িত ছিল। কিন্তু তারপরেও মনে করা হচ্ছে যে, ইরানের মাটিতে লক্ষ্যবস্তু চিহ্নিত করা এবং এই অভিযানকে পরিচালনা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে মোসাদ।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত অসংখ্য রিপোর্ট এবং কয়েকজন ইসরায়েলি কর্মকর্তার মন্তব্য থেকে এ বিষয়টা স্পষ্ট যে, অ্যান্টি সাবমেরিন সিস্টেম (সাবমেরিন বিধ্বংসী ব্যবস্থা), ক্ষেপণাস্ত্রের ভাণ্ডারকে নিশানা করার পাশাপাশি ইরানের কমান্ড সেন্টার এবং সে দেশের অভ্যন্তরে সুনির্দিষ্ট ব্যক্তিদের লক্ষ্য করে একযোগে এবং অত্যন্ত নিখুঁত পদক্ষতিতে হামলা চালানো হয়েছে। এ ধরনের পরিকল্পিত এবং নিখুঁত হামলা চালানো একমাত্র সে দেশের অভ্যন্তরে সক্রিয় গোয়েন্দা তৎপরতার মাধ্যমেই সম্ভব।

ইরানের গোয়েন্দা সক্ষমতার ব্যাপক ক্ষতি
ইসরায়েলি হামলায় শুধু ইরানের সামরিক ও পরমাণু স্থাপনাকেই নিশানা করা হয়নি, সে দেশে গোয়েন্দা সক্ষমতার ওপরেও মারাত্মকভাবে আঘাত হানা হয়েছে। এর ফলে ইরানের নেতা ও সামরিক কমান্ডারদের মধ্যে বিভ্রান্তি ও বিস্ময় দেখা দিয়েছে।

এই পরিস্থিতিতে হামলার পঞ্চম দিনে ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ডের পক্ষ থেকে প্রকাশিত এক আনুষ্ঠানিক বার্তা থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা গোয়েন্দা ঝুঁকি নিয়ে ব্যাপকভাবে উদ্বিগ্ন।

জারি করা এক নোটিশে কর্মকর্তা ও তাদের নিরাপত্তা দলকে মোবাইল ফোন, স্মার্ট ওয়াচ বা ল্যাপটপের মতো নেটওয়ার্ক-এর সঙ্গে যুক্ত ডিভাইস ব্যবহার না করার বিষয়ে সতর্ক করে দেওয়া হয়।

তবে এই সতর্কবার্তা কিন্তু শুধু কর্তৃপক্ষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সাধারণ মানুষকেও এসব ডিভাইসগুলোর ব্যবহার কমিয়ে ফেলার কথা বলা হয়। জনসাধারণকে এই বার্তা পাঠানো কিন্তু শুধু সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেওয়াকেই নয়, এই বিষয়েও ইঙ্গিত করে যে ইরানের অভ্যন্তরে সাইবার নিরাপত্তা লঙ্ঘনের আশঙ্কা দ্রুত এবং গভীরভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ইরানের অভ্যন্তরে অস্ত্র চোরাচালান, সমাবেশ ও অস্ত্র উৎপাদন
ইসরায়েলি ও পশ্চিমা গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিষয়টা শুধু ইরানের সংবেদনশীল তথ্য অব্দি পৌঁছানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। এই প্রতিবেদনগুলো এও ইঙ্গিত করে যে ইরানের মাটিতে আক্রমণাত্মক অস্ত্র তৈরি ও মোতায়েনের জন্য একটা সংগঠিত ব্যবস্থা তৈরি করে ফেলেছিল ইসরায়েল।

স্থানীয় এজেন্টদের নেটওয়ার্ক, এজেন্টদের গোপনীয়তা রক্ষার ব্যবস্থা করা, পরিবহন ব্যবস্থা এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই গোপন কর্মকাণ্ড দীর্ঘ সময় ধরে চলেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আর এই প্রস্তুতির ভিত্তিতেই সাম্প্রতিক হামলার ভিত্তি স্থাপন হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সামরিক বিষয়ক পর্যবেক্ষক সংস্থা ‘দ্য ওয়ার জোন’ এবং অন্যান্য সূত্রের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে যে, ইরাকের মধ্য দিয়ে যাওয়া ট্রাক, বাণিজ্যিক কন্টেইনার এবং যাত্রী স্যুটকেসের মধ্যে বিভিন্ন অংশে লুকিয়ে রেখে ইরানে অল্প অল্প করে সংবেদনশীল ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র সরঞ্জামের চোরাচালান করেছে ইসরায়েল।

এই ডিভাইসগুলোর মধ্যে বৈদ্যুতিন ফিউজ, উন্নত ইলেক্ট্রো- অপটিক্যাল ক্যামেরা, লিথিয়াম ব্যাটারি, হালকা ওজনের ইঞ্জিন, জিপিএস-ভিত্তিক গাইডেন্স সিস্টেম এবং সুরক্ষিত যোগাযোগ ডিভাইস অন্তর্ভুক্ত ছিল বলে মনে করা হচ্ছে।

প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব যন্ত্রাংশ পরে ইরানের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে ওঠা মোসাদ গোপন ঘাঁটিতে নিয়ে গিয়ে একত্রিত করে তাকে আক্রমণাত্মক অস্ত্রের আকার দেওয়া হয়েছে।

গত কয়েক বছর ধরে ইরানের বিভিন্ন অঞ্চলে গোপন ডেরা তৈরি করেছিল মোসাদের সদস্যরা। ইরানের বার্তা সংস্থাগুলো আরও জানিয়েছে যে তেহরানের কাছে এমনই একটি বহুতল ভবনের সন্ধান পাওয়া গেছে। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ওই ভবন ছিল আত্মঘাতী ড্রোন তৈরি ও সংরক্ষণের জন্য তৈরি করা ঘাঁটি।

ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের খবরে বলা হয়েছে, ওই ভবনের একটা ঘরের টেবিল এবং তাকের ওপরে অন্তত একটা ড্রোন, ড্রোন প্রপেলার, বিভিন্ন যন্ত্রাংশ এবং সেটাকে কন্ট্রোল করার সরঞ্জাম রাখা ছিল।

সেখানে একটা থ্রিডি প্রিন্টারও পাওয়া গেছে। এ ধরনের থ্রিডি প্রিন্টার ইউক্রেনে ড্রোনের যন্ত্রাংশ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ওয়ার জোন ওয়েবসাইট।

ইরানের পুলিশের এক মুখপাত্র গত ১৬ জুন জানান, তেহরানের একটি এলাকায় দুটি পৃথক অভিযানে মোসাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুজন এজেন্টকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে ২০০ কেজির বেশি বিস্ফোরক, ২৩টি ড্রোনের যন্ত্রাংশ, লঞ্চার, কন্ট্রোল সিস্টেম এবং একটা নিশান গাড়ি উদ্ধার করা হয়েছে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

ইস্পাহানে যেখানে ইরানের সবচেয়ে স্পর্শকাতর পরমাণু স্থাপনা রয়েছে, সেখানে এক কর্মশালায় পুলিশের ডেপুটি কমান্ডার অভিযান চালান। সেখানে বিপুল সংখ্যক ড্রোন এবং মাইক্রো-ড্রোন তৈরির সরঞ্জাম এবং যন্ত্রাংশ সংরক্ষণ করা হয়েছিল বলে অভিযোগ। এই ঘটনায় জড়িত সন্দেহে চারজনকে এরই মধ্যে আটক করা হয়েছে।

এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ড্রোনগুলো থ্রিডি প্রিন্টার এবং স্থানীয় হার্ডওয়্যারের মাধ্যমে অ্যাসেম্বল করা হচ্ছিল যাতে বেশি পরিমাণে খুচরা যন্ত্রাংশ চোরা-গোপ্তাভাবে আনতে না হয় এবং সুরক্ষা এজেন্সিগুলোর জন্য সরবরাহের এই শৃঙ্খলকে শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। তবে এসব বিষয় যাচাই করা সম্ভব হয়নি।

ইরানের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো এর আগেও বেশ কয়েকবার ইসরায়েলের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির সন্দেহে অভিযোগে বিভিন্ন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে।

স্মার্ট অস্ত্রের ব্যবহার
দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইসরায়েলের গোপন অভিযানের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো তারা ইরানের মাটিতে হালকা ওজনের, নির্ভুল ও রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে কাজ করে এমন ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে।

এ ধরনের আধুনিক ও বিশেষ প্রযুক্তিতে তৈরি অস্ত্র কোনো অপারেটরের উপস্থিতি ছাড়াই ইরানের ভেতর থেকে নিক্ষেপ করা যায়। প্রযুক্তিগতভাবে এটা এমন একটা অভিযান যা ঐতিহ্যগত পদ্ধতিগুলোকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে।

ইরানের ইংরেজি নিউজ চ্যানেল ‘প্রেস টিভি’ গত সোমবার তাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে লিখেছে, ইরানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এমন ধরনের স্পাইক মিসাইল লঞ্চার উদ্ধার করেছে, যেগুলো ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে লক্ষ্যবস্তু হিসাবে নিশানা করার জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছিল। এই সিস্টেমগুলো ইন্টারনেট-অটোমেশন এবং রিমোট কন্ট্রোল দ্বারা সজ্জিত ছিল।

ওই নিউজ চ্যানেলের মতে, এই সিস্টেমগুলো পরিচালনা করছিলেন মোসাদের এজেন্টরা। স্পাইক মিসাইল লঞ্চারের ছবিতে দেখা গেছে সেগুলো কোনো যান বা ড্রোনে মোতায়েন করা হয়নি। কভার ব্যবহার করে মাটিতে দাঁড় করানো একটা ট্রাইপডে মোতায়েন করা হয়েছিল।

এই লঞ্চারগুলো ইলেক্ট্রো-অপটিক্যাল গাইডেন্স সিস্টেম, অত্যাধুনিক ক্যামেরা এবং স্যাটেলাইট যোগাযোগ অ্যান্টেনা দিয়ে সজ্জিত। তাই দূর থেকেই কমান্ড (নির্দেশ) নিতে পারে এই ডিভাইস।

অতীতেও ইরানের বিরুদ্ধে রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে কমান্ড নিতে সক্ষম এমন অস্ত্র ব্যবহার করতে দেখা গেছে ইসরায়েলকে।

উদাহরণস্বরূপ ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে ইরানের কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন সে দেশের পারমাণবিক কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত একজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানীকে এমন রিমোট কন্ট্রোল অস্ত্র দ্বারা হত্যা করা হয়েছে যা একটা পিকআপ ভ্যানে লাগানো ছিল। কোনো আক্রমণকারী কিন্তু সেসময় উপস্থিত ছিল না।

মন্তব্য করুন