পবিত্র ঈদুল আজহা—বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর জন্য এক তাৎপর্যপূর্ণ দিন। এ দিনটি কেবল উৎসবের নয়, বরং ত্যাগ, আত্মসমর্পণ ও খোদাভীতির এক মহিমান্বিত নিদর্শন। ঈদুল আজহার প্রকৃত তাৎপর্য অনুধাবন করতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হয় ইতিহাসের সেই গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ে, যেখানে এক পিতা ও পুত্র নিঃস্বার্থভাবে আল্লাহর আদেশ পালনে নিজেদের প্রস্তুত করেছিলেন।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: ইব্রাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.)-এর কুরবানির কাহিনি হযরত ইব্রাহিম (আ.) এক রাতে স্বপ্নে দেখেন—তিনি আল্লাহর আদেশে তাঁর পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে কুরবানি করছেন। একজন পিতার জন্য এটি ছিল এক কঠিনতম পরীক্ষার মুহূর্ত। কিন্তু আল্লাহর সন্তুষ্টিকে সর্বোচ্চে স্থান দিয়ে তিনি প্রস্তুত হলেন এই আত্মত্যাগে।
আল্লাহ তাআলা বলেন: “আল্লাহর কাছে পৌঁছে না এগুলোর গোশত ও রক্ত; বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।” (সূরা হজ্জ, ২২:৩৭) এই আয়াত আমাদের মনে করিয়ে দেয়, কুরবানির প্রকৃত উদ্দেশ্য পশু জবাই নয়; বরং তাতে নিহিত হৃদয়ের খাঁটি নিয়ত, তাকওয়া ও আল্লাহভীতি।
রাসূল (সা.)-এর বাণী ও কুরবানির গুরুত্ব রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন: “মানুষ কুরবানির দিনে যে কাজ করে, তার মধ্যে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় হলো কুরবানি করা। কিয়ামতের দিন তা শিং, চামড়া ও খুরসহ নিয়ে আসবে। আর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই তা আল্লাহর কাছে কবুল হয়ে যায়।” (তিরমিজি: ১৪৯৩)
তিনি আরও বলেন: “যে ব্যক্তি কুরবানি করার সামর্থ্য রাখে কিন্তু কুরবানি করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।” (ইবনে মাজাহ: ৩১২৩) এই হাদিসদ্বয় কুরবানির গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য আমাদের সামনে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে।
সমাজে কুরবানির শিক্ষা ও প্রভাব
কুরবানি কেবল একটি ধর্মীয় ইবাদত নয়; এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক দায়িত্বও। ধনী ও গরিবের মধ্যে সম্প্রীতি, সহানুভূতি ও ভালোবাসার সেতুবন্ধন তৈরি হয় এই ইবাদতের মাধ্যমে।
ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী, কুরবানির মাংস তিনভাগ করে আত্মীয়-স্বজন, গরিব-দুস্থ ও নিজের পরিবারের মধ্যে বণ্টন করা উচিত। এই বণ্টন প্রক্রিয়া মানবিকতা ও পারস্পরিক সহযোগিতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
আজকের আধুনিক শহুরে জীবনে অনেকেই কুরবানি সার্ভিসের মাধ্যমে সম্পন্ন করেন। তবে এতে যেন আন্তরিকতা, করুণা ও খালেস নিয়তের ঘাটতি না হয়, সে দিকেও সচেতন থাকা আবশ্যক।
পরিচ্ছন্নতা ও পরিবেশ-সচেতনতা
ইসলাম পরিচ্ছন্নতার ধর্ম। কুরবানির সময় রক্ত, বর্জ্য ও দুর্গন্ধ যেন জনদুর্ভোগ সৃষ্টি না করে, সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখা প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব। রাসূল (সা.) বলেন: “পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অর্ধেক।” (সহিহ মুসলিম) তাই পশু জবাই, বর্জ্য অপসারণ ও পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা শুধু সামাজিক নয়, ধর্মীয় দিক থেকেও আমাদের কর্তব্য।
উপসংহার
ঈদুল আজহা আমাদের শিক্ষা দেয় আত্মত্যাগ, আনুগত্য ও মানবিকতার। কুরবানির মাধ্যমে শুধু পশু জবাই নয়, বরং আমাদের অহংকার, লোভ, হিংসা, কুপ্রবৃত্তি কুরবানি করে সত্যিকার আত্মশুদ্ধির পথে অগ্রসর হওয়া উচিত।
আসুন, এ ঈদে ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হোক প্রতিটি হৃদয়; পবিত্র হোক আমাদের নিয়ত, চিন্তা ও আমল। তাহলেই ঈদের প্রকৃত আনন্দ ও উদ্দেশ্য পূর্ণতা লাভ করবে।
আল আমিন সরকার
শিক্ষার্থী
আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিশর।
মন্তব্য করুন