ছবিটি কোনো ময়লার ভাগাড়ের নয়, ছবিটি ফেনী জেলার একটি খালের। তবে ময়লা ফেলে খালটির যে হাল করা হয়েছে, তাতে ভাগাড় বললেও খুববেশি বাড়িয়ে বলা হয় না।
ময়লা-আবর্জনা ফেলে জেলার নদী, শাখা নদী ও খালের স্রোতধারা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বর্ষা মৌসুমে জলবদ্ধতা তৈরি একটি নৈমিত্তিক সমস্যা। প্রতি বর্ষায় জলাবদ্ধতার কারণে ফেনী শহরের রাস্তাঘাট নদীর মতো দেখা যায়। সামান্য বৃষ্টিতে হাঁটুপানি জমে যায় শহরের প্রতিটি সড়কে। এ ছাড়াও অবৈধ দখলের কারণে খালগুলো বর্তমানে নর্দমায় পরিণত হয়েছে। ময়লার কারণে কিছু কিছু স্থানে নর্দমার অস্তিত্বও বিলীন হয়ে গেছে।
ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্র জানায়, জেলার সোনাগাজী উপজেলার ৫৬টি, দাগনভূঞার ৫২টি, সদর উপজেলার ৩৯টি, পরশুরামের ৪টি, ছাগলনাইয়ার তিনটি ও ফুলগাজীর ৯০টি খালই দখল-দূষণে মৃতপ্রায়।
ফেনীর ছয় উপজেলার অন্তত ২৪৪টি খাল ও শাখা নদী অবৈধ দখল-দূষণের কবলে। বেশিরভাগ খাল বেদখলে বেহাল, অথবা দূষণে ভরাট হয়ে আছে। ফলে সেগুলো দিয়ে শহরের পানি দ্রুত নামতে পারছে না।
গত বছরের ভয়াবহ বন্যায় বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে ভারী বর্ষণ ও ভারতীয় উজানের পানিতে সৃষ্ট বন্যায় মানুষজনের পাশাপাশি ক্ষতির শিকার হয় ঘরবাড়ি, কৃষিজমি, পুকুর-খামার ও গবাদিপশু। পানি উন্নয়ন বোর্ড ও পৌর কর্তৃপক্ষ দফায় দফায় উদ্যোগ নিয়েও খাল ও শাখা নদীগুলোর অবৈধ স্থাপনা নানা জটিলতায় উচ্ছেদ করতে পারছে না; পারছে না খালগেুলোর সংস্কার করতেও।
দখল হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি ফেনীর খাল-নদী পলি মাটি জমে ভরাট হয়ে নাব্যতা হারিয়ে। সেই সঙ্গে ময়লা-আবর্জনা জমে থাকায় দূষিত হয়ে কোথাও কোথাও সেগুলো সংকুচিত হয়ে পড়েছে। এসব খালের পানির প্রবাহ ঠিক করা না গেলে বর্ষা মৌসুমে জলবদ্ধতার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। পৌরসভার পক্ষ থেকে খালগুলো পরিষ্কারের পদক্ষেপ নিলেও পুনরুদ্ধারের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায় না।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পাগলিছড়া, পিটিআই ও খাজা আহাম্মদ লেক খালগুলোর মধ্যে কয়েকটি খালের অস্তিত্ব বিলীনের পথে। যেগুলো আছে সেগুলো এখন আর পানি প্রবাহের জায়গা নয়, বরং প্লাস্টিক বোতল, পলিথিন, খাবারের প্যাকেটসহ বিভিন্ন বর্জ্যে ভর্তি একেকটি ময়লার ভাগাড়ে রূপ নিয়েছে। এসবের ফলে জলাবদ্ধতা, দুর্গন্ধ ও মশার উপদ্রব শহরবাসীর নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছে।
২০১১ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ফেনী পৌরসভা এলাকার খাজা আহম্মেদ লেক, পাগলিছড়া খাল, জেল রোডের পিটিআই সংলগ্ন খালের ওপর নির্মাণ করা হয়েছে মার্কেট। ফলে কোথাও খাল বন্ধ, আবার কোথাও হয়েছে সংকুচিত। যার ফল ভোগ করতে হচ্ছে পৌরবাসীর। এ ছাড়া রয়েছে অব্যবস্থাপনাও।
দখল-দূষণে মৃতপ্রায় শহরের দমদমা খাল। এক সময় এ খালেই চলাচল করত মালবাহী বাণিজ্যিক নৌকা। ছোট-বড় নৌকাগুলো ভিড়ত শহরতলীর দাউদপুল এলাকায়। সারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নানা পণ্যের সমারোহে বসত মাসব্যাপী রাসমেলা। ফেনী শহরের দোকান মালিকদের মালামাল আনা-নেওয়া ও ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম ভরসা ছিল এই খাল।
দাগনভূঞা উপজেলার রাজাপুর বাজার সংলগ্ন দত্তের খালটি। দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ায় এবং আশপাশের ময়লা-আবর্জনা ফেলায় ও দখল-দূষণের কারণে বর্তমানে এটি অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। দাগনভূঞার ১৯ কিলোমিটার বিস্তৃত দাদনা খালটি স্থানীয় প্রভাবশালী, রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের পেটে চলে গেছে। দাদনা খালের প্রশস্ততা ৬৫ ফুট হলেও এখন ১০ ফুট বা কোথাও ১৫ ফুট টিকে আছে। সোনাগাজীর ডাঙ্গি খাল এখন নালায় পরিণত হয়েছে। খালের চারপাশে ও উপরে বিভিন্ন সময় প্রভাবশালীরা স্থাপনা নির্মাণ করে দখল করায় পানিপ্রবাহ কমে গেছে।
ফেনী শহরের বাসিন্দা শরীফুল ইসলাম রাসেল জানান, শহরের দাউদপুর খাল ও পাগলিছড়া খালের পাশে প্রতিনিয়ত ময়লা-আবর্জনা ফেলে খাল দখল করা হয়েছে। আড়তের ময়লায় শুধু খালের পানি দূষণই হচ্ছে না, সেই সঙ্গে বন্ধ হচ্ছে পানির প্রবাহ। শহরের অন্য খালগুলোর দশাও প্রায় এক। পানিপ্রবাহের গতিরোধ হওয়ায় সামান্য বৃষ্টিতে একাডেমি এলাকার নিম্নাঞ্চল ডুবে যায়।
প্রবীণ সাংবাদিক বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহের জানান, খাল দখলের এ প্রক্রিয়া এক-দুদিনের নয়। গত ৩০ থেকে ৪০ বছর ধারাবাহিকভাবে খালগুলো একটু একটু করে দখল হচ্ছে। অনেক খাল কাগজে-কলমে থাকলেও বাস্তবে বিলীন। এসব খাল ও পানির প্রবাহ ধ্বংস করার করুণ পরিণতি এবারের বন্যায় মানুষ দেখেছে। বন্যা দীর্ঘায়িত হওয়ার বড় কারণ পানির প্রবাহগুলো নষ্ট হওয়া।
ফেনী পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আক্তার হোসেন মজুমদার বলেন, ‘খাল ও নদীর ৭১৯ কিলোমিটার অংশের মধ্যে বিগত পাঁচ বছরে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার পুনরর্খনন করা হয়েছে। বন্যায় জলবদ্ধতা ও মানুষের দুর্ভোগ কমাতে বরাদ্দ পেলে ফেনীর নদ-নদী ও খালগুলো খনন ও সংস্কার করে পানির প্রবাহ স্বাভাবিক করা হবে।’
শহরের খালগুলো দীর্ঘদিন খনন বা সংস্কার না করার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এসব এলাকার খাল সংস্কার করবে স্ব-স্ব কর্তৃপক্ষ।’
ফেনী পৌর প্রশাসক গোলাম মো. বাতেন বলেন, ‘খালগুলো দূষণ থেকে রক্ষা করার বিষয়ে পৌরসভার পক্ষ থেকে ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কারে কার্যক্রম চলমান রয়েছে। আগামী বর্ষায় জলবদ্ধতা থেকে রেহাই পাবে পৌরবাসী।’
খালগুলো অবৈধ দখলের ফলে অস্তিত্বহীন হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘খালগুলো পুনরুদ্ধার নানা জটিলতার কারণে সম্ভব হচ্ছে না। তবে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থার পর ক্রমান্বয়ে অবৈধ দখল থেকে খালগুলো উদ্ধারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
পরিবেশ অধিদপ্তর ফেনীর উপপরিচালক মোসাম্মৎ শওকত আরা কলি বলেন, ‘সাধারণ মানুষের সচেতনতার অভাবেই খালে প্লাস্টিক ও পলিথিন ফেলা হচ্ছে। যার ফলে খালগুলো মারাত্মকভাবে দূষিত হয়ে পড়ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘খাল সংরক্ষণ বা পরিষ্কার করার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের নয়। এটি মূলত পৌরসভার আওতাভুক্ত কাজ।’
মন্তব্য করুন