রবিবার, ০১ জুন ২০২৫, ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
জাতীয়প্রবাস বাংলাঅপরাধবাণিজ্যরাজনীতিঅন্যান্যসারাদেশমতামতস্বাস্থ্যফিচাররাজধানীপাঠকের কথাআবহাওয়াশিল্প-সাহিত্যগণমাধ্যমকৃষি ও প্রকৃতিইসলামবৌদ্ধহিন্দুখ্রিস্টানআইন-বিচারবিবিধআপন আলোয় উদ্ভাসিতবেসরকারি চাকুরিসরকারি চাকুরি Photo Video Archive

রবিবার, ০১ জুন ২০২৫, ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

‘বিজয় মিছিল শেষে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে স্বামী’

নিজস্ব প্রতিবেদক
  ২৫ মে ২০২৫, ০৭:১৩
ছবি-সংগৃহীত

আব্বা আগে কাম থ্যাইক্যা আইসা দুই বোনকে কোলে কইরা দোকানে নিয়া কত কিছু কিনা দিতো। এখন আমার আব্বা নাইকা। মইরা গেছে।

সেদিনক্যা বাড়িতে আইসা মারে কইছে, আমার ভালো লাগতেছে না, পানি দাও। এরপর আব্বায় আল্লাহর কাছে চইলা গেছে। আমরা আব্বা আর ফিরা আসফিনা (ফিরবে না)। 

সিরাজগঞ্জ জেলার কামারখন্দ উপজেলার বৈদ্য জামতৈল এলাকার প্রামানিক পাড়া গ্রামের বাসায় রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস-এর প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে কথাগুলো বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ মো. শিহাব উদ্দিনের ৪ বছর বয়সী মেয়ে মরিয়ম।

শহীদ মো. শিহাব উদ্দিন কামারখন্দ উপজেলার প্রামানিক পাড়া গ্রামের সেলিম প্রামাণিকের (৬০) ছেলে। মা ছামেলা খাতুন (৫০)। অসুস্থ বাবা-মা ছাড়াও স্ত্রী ময়না খাতুন (৩৪) এবং দুই মেয়ে মোরসালিনা (৭) ও মরিয়ম (৪) রয়েছে।

শিহাব ১৯৯১ সালের ১ জানুয়ারি জন্ম গ্রহণ করেন। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে শিহাব উদ্দিন ছিলেন সবার বড়। মেজভাই নাসিম (৩০) ঢাকার একটি গার্মেন্টেসে চাকুরী করেন আর ছোট ভাই নাজমুল (২৫) করেন এলাকায় রাজমিস্ত্রীর কাজ। 

স্ত্রী ময়না খাতুন গৃহিণী। বড় মেয়ে মোরসালিনা স্থানীয় একটি স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণি এবং ছোট মেয়ে মরিয়ম প্লেœ-তে পাড়ালেখা করছে। ৫ আগস্ট বিকেল চারটার দিকে শিহাব উদ্দিন শহীদ হন। পরে রাত ১১ টার দিকে জামতৈল পশ্চিমপাড়া কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

শিহাবের স্ত্রী ময়না খাতুন জানান, আমার স্বামী বিজয় মিছিল শেষে বাড়িতে এসে বলে আমার ভালো লাগছে না। আমাকে বলে, ‘একটু পানি দাও।’ এই বলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। আমরা তার চিকিৎসা করার মতো সময়ও পাইনি।’

সেদিনের ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ কারার পর সারাদেশে বিজয় মিছিল হয়। সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলাতেও ওই দিন বিকেলে ছাত্র-জনতা বিজয় মিছিল বের করে।

এই বিজয় মিছিল শেষে বাড়িতে ফিরে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ে আমার স্বামী। আমার স্বামী সকাল ১০ টার পর থেকেই মিছিলে ছিল। শুনেছি স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দুপুরের দিকে মিছিলে হামলা চালায়। তার বুকে লাঠি ও হকিস্টিক দিয়ে আঘতা করেছিল।  

শিহাবের স্ত্রী ময়না আরও বলেন, বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় বারবার নিষেধ করলাম: ‘তুমি যাইও না। আমরা গরীব মানুষ। আমাদের ধার-দেনা আছে। তোমার কিছু হলে আমরা কী করব। আজ বাসা থেকে বের হওয়ার দরকার নেই।’ সে বলেছিল, ‘কোনে সমস্যা নাই। কিছুই হবে না। সমস্যা দেখলে চলে আসবো।’

ময়না বলেন, ‘আমার কোনো আয়-রোজগার নাই। শিহাব কোনো টাকা-পয়সা জমিয়ে যায়নি। আমারা বিভিন্ন সংস্থা থেকে ঋণ নেওয়া আছে। কিস্তি দিতে হয় প্রতি সপ্তায়।

আমাদের কোনো জমি-জমাও নাই। মেয়ে দুটি নিয়ে কীভাবে চলব,  এদের পড়াশোনার কী হবে? কীভাবে কী করব বুঝতে পারছি না।’

আব্বুর কথা কি খুব মনে পড়ে? এমন প্রশ্নের জবাবে শহীদ শিহাবের বড় মেয়ে মোরসালিনা বলে, ‘আব্বু আমাদের রেখে চলে গেছে। আব্বু কাজ থেকে ফিরে এসে আমাদের দুই বোনকে কোলে নিয়ে দোকানে যেত। আমাদের অনেক খাবার কিনে দিত। বিকেল হলেই আব্বুর কথা খুব মনে পড়ে।’ এই বলে সে কান্না করতে করতে থেকে ঘর থেকে বের হয়ে যায়।

শহীদ শিহাব উদ্দিনের মা ছামেলা খাতুন বলেন, ‘কথা কতি কতি আমার বাবাটা মরে গেল। ওর সংসারের অবস্থা ভালো না। কখনও ভ্যান চালাতা, কখনও কামলা (দিনমজুর) দিত। বেটা চলে গেল। আমরা এখন কীভাবে চলমু। কেবা কইরা তার মেয়েদের পালমু, কেবা কইরা তার বউকে দেইখা রাখমু। আমরা এটা আর সহ্য করতে পারতেছি না। খুব খারাপ অবস্থার মধ্যে পড়ে গেছি। আমাদের খুবই সমস্যা। সরকার যদি আমাদের দিকে একটু চাইত!

নিহতের প্রতিবেশী রুমা খাতুন বলেন, ‘শিহাব খাইত ভ্যান চালাইয়া। এই পরিবারের বড় ছেলেটাই মারা গেল। এই মেয়ে দুইটা নিয়া চলার সামর্থ্য ওর মার নাই। মেয়ে দুইটা নিয়ে যেন বউটা ভালোভাবে চলতে পারে, বাঁচতে পারে আপনারা যদি এ রকম কিছু কইরা দেন তাহলে ভালো হয়।’

শহীদ শিহাবের বাবা সেলিম বলেন, ‘ছেলে তো চলেই গেছে। ছেলেটার বউ রইছে। দুইটা মেয়ে রইছে। আমার চাওয়া শিহাবের মেয়ে দুইটা যাতে ভালোভাবে চলতে পারে, পড়ালেখা শিখতে পারে, সরকার যেন সেই ব্যবস্থা করে দেয়।’

সরেজমিনে কামারখন্দ উপজেলার তাঁজুরপাড়া গ্রামে শিহাব উদ্দিনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ছোট একটি দোচালা টিনের ঘর। সেখানেই থাকেন শিহাবের স্ত্রী ও দুই মেয়ে।

আর পাশে একটি ছোট রুœম আছে, সেখানে থাকে তার বাবা-মা। কোনো রুমে তেমন কোনো আলো-বাতাস প্রবেশের পথ নেই। বাড়ির মধ্যে স্যাঁতস্যাঁতে একটা পরিবেশ।

ঘর-বাড়ির অবস্থা দেখলেই বোঝা যায় কী নিদারুণ কষ্টে সংসার চলে শহীদ শিহাবের পরিবারের। তিন ভাইয়ের সবাই আলাদা হয়ে গেছেন অনেক বছর আগেই।

সরকারি সহযোগিতা পেয়েছেন কি না- এমন প্রশ্ন করা হলে শিহাবের স্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী শুধু দুই লাখ টাকা দিয়েছে। জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে পাঁচ লাখ টাকা পেয়েছি। এছাড়াও বিএনপি, এনসিপি, সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন, তারা কিছু সহযোগিতা দিয়েছেন।

স্ত্রী ময়না খাতুন আরও বলেন, আমার স্বামী খুবই ভালো মানুষ ছিলেন। নামাজ পড়তেন। মানুষকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করতেন। তার ইচ্ছা ছিল জনপ্রতিনিধি হওয়ার। এই ওয়ার্ডে মেম্বর পদে ভোট করতে চেয়েছিলেন। আমাদের সংসারে অভাব থাকলেও সবাই মিলেমিশে থাকতাম। কিন্তু আল্লাহ আমার কপালে সুখ লিখে রাখেনি, তাই অসময়ে স্বামীকে হারাতে হয়েছে।

তিনি বলেন, আমার দুই মেয়ে লেখা পড়ায় খুব ভালো। এই বছর তারা ক্লাসে প্রথম হয়েছে। ওর বাবার ইচ্ছা ছিল মেয়ে দুইটাকে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলার।

আমি কি পারব ওর বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে? মেয়েদের পড়া লেখা করাতে গেলে তো অনেক খরচ, আমি এত টাকা পাবা কোথায়?

‘এখনও আমার অনেক ঋণ আছে’ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সরকার যদি কোন ব্যবস্থা করতো তাহলে আমার জন্য ভালো হয়।’

নিহতদের শহীদের মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানিয়ে ময়না বলেন, যারা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত হয়েছেন, তাদের সবাইকে রাষ্ট্রীয়ভাবে শহীদের মর্যাদা দিতে হবে। একই সাথে আমার স্বামীকে যারা হত্যা করেছে তাদের খুঁজে বের করে কঠিন শাস্তি দিতে হবে।

মন্তব্য করুন