রবিবার, ০১ জুন ২০২৫, ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
জাতীয়প্রবাস বাংলাঅপরাধবাণিজ্যরাজনীতিঅন্যান্যসারাদেশমতামতস্বাস্থ্যফিচাররাজধানীপাঠকের কথাআবহাওয়াশিল্প-সাহিত্যগণমাধ্যমকৃষি ও প্রকৃতিইসলামবৌদ্ধহিন্দুখ্রিস্টানআইন-বিচারবিবিধআপন আলোয় উদ্ভাসিতবেসরকারি চাকুরিসরকারি চাকুরি Photo Video Archive

রবিবার, ০১ জুন ২০২৫, ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

৫ আগস্টই হয়ে উঠল অন্তরের বিদায়ের দিন

নিজস্ব প্রতিবেদক
  ০৫ মে ২০২৫, ১২:১৩

সেদিন ছিল ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। বিজয়ের মিছিল এগিয়ে যাচ্ছিল শফিপুর আনসার একাডেমির দিকে। রাজধানীজুড়ে তখন উৎসবমুখর জনতা, সবার  চোখে বৈষম্যমুক্তির দুর্নিবার স্বপ্ন আর হৃদয়ে স্বৈরাচার পতনের অনিন্দ্য আনন্দ। এই উৎফুল্ল জনতার অংশ ছিলেন অন্তর। আগের দিন গায়ে গুলি লেগেছে।

অসুস্থ শরীর। তবু দমে যাননি তিনি। ফ্যাসিস্ট সরকার পতনের বিজয়ের মিছিলে ছিলেন সামনের সারিতে।

কিন্তু সেই দিনটিই হয়ে উঠল তার বিদায়ের দিন। পুলিশের গুলিতে মুখ ও মাথায় ক্ষতবিক্ষত ও রক্তাক্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। যে তরুণ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন, তিনি সেদিন শহীদ হলেন রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের এক নির্মম সাক্ষ্য হয়ে।

সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার কৈজুরী গ্রামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ অন্তর ইসলামের বাড়িতে রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস-এর প্রতিবেদকের কথা হয় অন্তর ইসলামের মা জয়নব খাতুনের সঙ্গে।

অন্তর ইসলামের মা বলেন, 'অন্তর গাছ লাগাতে ভালোবাসত। গাছ লাগানো ছিল তার নেশা। কোনোভাবে তার হাতে টাকা এলেই সে গাছ কিনে এনে বাড়ির আঙিনায় লাগাত। মাত্র তিন শতাংশ জায়গার ওপর বাড়ি। অথচ এমন কোনো ফলের গাছ নেই, যা বাড়ির আঙিনায় নেই। শুধু নিজের বাড়িতে নয়, বোনের বাড়ি বেড়াতে গেলেও সে বাজার থেকে বিভিন্ন জাতের গাছ কিনে কিনে রোপণ করত।'

জয়নব খাতুন বাড়ির আঙিনায় অন্তরের নিজ হাতে লাগানো আম গাছ, লেবু গাছ দেখিয়ে বলেন, 'দেখো, ওর লাগানো আম গাছে কত আম ধরেছে! লেবু গাছে কত লেবু! কিন্তু এই আম অন্তর আর খেতে পারবে না। বাড়িতে আর জায়গা নেই, তাই ওকে গাছ লাগাতে নিষেধ করতাম। ও শুনত না। আজ এই গাছগুলোর দিকে তাকালেই ওর কথা মনে পড়ে। মনে হয়, এই গাছের সবুজে মিশে আছে আমার অন্তরের আত্ম।'

এ সময় অন্তরের দুলাভাই সাজ্জাদুল হক তপু বলেন, 'ও আমার শ্যালক হলেও আমি অন্তরকে কখনোই শ্যালকের চোখে দেখতাম না, নিজের  সন্তানের মতো দেখতাম ওকে। ওর যত আবদার, চাওয়া-পাওয়া সবই ছিল আমার কাছে।'

তিনি বলেন, 'সময় পেলেই আমার বাড়িতে চলে যেত। কোথাও কোনো গাছ পছন্দ হলেই বলত, ‘দুলাভাই, ওই গাছটা কিনতে হবে।’ আমাদের বাড়িতে সব ধরনের ফলগাছ রয়েছে—সবগুলোই অন্তররের হাতে লাগানো। ওকে যে এইভাবে হারাতে হবে, কখনো কল্পনাও করিনি।'

শহীদ মো. অন্তর ইসলাম সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার কৈজুরী হাট ইউনিয়নের কৈজুরী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ২০০২ সালের ২ জানুয়ারি। বাবা মো. আব্দুল হক (৬৫) ও মা মোছাম্মৎ জয়নব খাতুন (৬০)। দুই ভাই ও চার বোনের মধ্যে অন্তর ছিলেন সবার ছোট। বড় ভাই আলাদা থাকেন এবং বোনদের বিয়ে হয়ে গেছে। অন্তর নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি পরিবার চালানোর জন্য কঠোর পরিশ্রম করতেন।

২০০৭ সালের বন্যায় তাদের বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। পরে অনেক কষ্টে তিন শতাংশ জমি কিনে নতুন বাড়ি তৈরি করে বসবাস করত তাদের পরিবার। অন্তরদের কোনো কৃষিজমি নেই। বাবা আগে ছোটখাটো ব্যবসা করতেন, কিন্তু অসুস্থতার কারণে এখন কোনো আয় নেই। একমাত্র আয়ের উৎস ছিলেন অন্তর ইসলাম। তাকে হারিয়ে পরিবারটি এখন অসহায়।

শাহজাদপুর সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। পরিবারের খরচ চালানোর জন্য অন্তর গাজীপুরের শফিপুরে অ্যাপেক্স কোম্পানিতে চাকরি করতেন। গাজীপুর থেকে পরীক্ষার সময় এসে পরীক্ষা দিয়ে আবার ফিরে যেতেন। পরিবারের খরচ ও নিজের পড়াশোনার খরচ তিনিই চালাতেন।

শহীদ অন্তরের মা জয়নব খাতুন বলেন, 'ছেলে আমার টাকার অভাবে পড়াশোনা বন্ধ করে নাই। নিজে উপার্জন করে পড়াশোনার খরচ ও পরিবার চালিয়েছে। ওর ইচ্ছা ছিল পড়াশোনা শেষ করে ভালো একটা চাকরি পেলে পরিবারের দুঃখ ঘোচাবে। আমাকে বলত, ‘আম্মু, আর দুইটা বছর কষ্ট করো, তারপর আমি চাকরি পেলে তোমাদের আর কষ্ট থাকবে না।’ এখন আমাদের ওষুধ কে কিনে দেবে, ওরবাবার ওষুধ কে কিনে দেবে?'

ছেলের হত্যার বিচার চেয়ে তিনি বলেন, 'সরকারের কাছে আমি ছেলে হত্যার বিচার চাই। আমার ছেলেকে যারা হত্যা করেছে, তাদের কঠিন শাস্তি চাই। এই পরিবারের উপার্জনের আর কেউ নেই। যাতে ওর বাবা আর আমি কোনোভাবে খেয়েুপরে বাঁচতে পারি, সরকার যেন সেই ব্যবস্থা করে।'

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের ডাকে দেশের ছাত্রুজনতা রাজপথে নামে। উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকাসহ পুরো দেশ। সেই আন্দোলনে অংশ নেন অন্তর ইসলাম।

২০২৪ সালের ৪ আগস্ট পুলিশের ছোড়া রাবার বুলেটে আহত হন শহীদ অন্তর। ৫ আগস্ট, যখন জনগণের চূড়ান্ত বিজয় ঘটে, সেদিন অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও বিজয় মিছিলে অংশগ্রহণ করেন অন্তর ইসলাম।

বিজয় মিছিল শফিপুর আনসার একাডেমির দিকে অগ্রসর হতে থাকলে পুলিশ বাহিনী বিজয় মিছিলে গুলি চালায়। এ সময় একটি গুলি চোখের ভিতর দিয়ে ঢুকে পেছন দিয়ে বের হয়ে যায় এবং অন্যটি কপাল দিয়ে ঢুকে মাথার পেছন দিয়ে বের হয়। সাথে সাথেই তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।

প্রথমে তার লাশের কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা খুঁজে বের করে তাকে কালিয়াকৈর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সেইদিনই রাত ২টা ৩০ মিনিটে অন্তরের লাশ গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়।  পরের দিন ৬ আগস্ট সকাল ৯ টায় কৈজুরী মাদ্রসা মাঠে জানাজা নামাজ শেষে কৈজুরী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। 

 আগস্ট সকাল অন্তর ইসলাম আজ আর নেই। কিন্তু তার লাগানো প্রতিটি গাছ, গাছের প্রতিটি পাতায়, ডালে ডালে যে জীবন তিনি বুনে গেছেন, তা আজও তার অস্তিত্বের সজীব স্মারক হয়ে নীরবে গেয়ে যায় জীবনের গান- অবিরাম।

মন্তব্য করুন