শুক্রবার, ১৬ মে ২০২৫, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
জাতীয়প্রবাস বাংলাঅপরাধবাণিজ্যরাজনীতিঅন্যান্যসারাদেশমতামতস্বাস্থ্যফিচাররাজধানীপাঠকের কথাআবহাওয়াশিল্প-সাহিত্যগণমাধ্যমকৃষি ও প্রকৃতিইসলামবৌদ্ধহিন্দুখ্রিস্টানআইন-বিচারবিবিধআপন আলোয় উদ্ভাসিতবেসরকারি চাকুরিসরকারি চাকুরি Photo Video Archive

শুক্রবার, ১৬ মে ২০২৫, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

‘এখন মায়ের দিন কাটে ছেলের চিতার পাশে বসে’

নিজস্ব প্রতিবেদক
  ১২ মার্চ ২০২৫, ১৩:৪৩

২০২৪ সালের জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানের সাহসী যোদ্ধা হৃদয় চন্দ্র তরুয়ার কণ্ঠনালী শুধু ছিন্নভিন্ন করেই ক্ষান্ত হয়নি ঘাতক বুলেট; একই সঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে তার দরিদ্র বাবা-মায়ের বহুদিনের লালিত সব স্বপ্ন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সম্মান তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী হৃদয় চন্দ্র তরুয়া পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার আন্দুয়া গ্রামের দরিদ্র কাঠমিস্ত্রি রতন চন্দ্র তরুয়া ও মা অর্চনা রানীর একমাত্র সন্তান ছিলেন।

২২ বছর বয়সী হৃদয়ের কণ্ঠনালীতে এক পাশ দিয়ে প্রবেশ করা বিষাক্ত বুলেট তার স্বরযন্ত্র সম্পূর্ণ ছিন্নভিন্ন করেঅন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই বন্দুকধারীদের এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণের সময় তিনি গুলিবিদ্ধ হন।

সেদিন বন্দুকধারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের আশ্রিত সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যরাও বিক্ষোভকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। সে সময়কার গণজাগরণের অন্যতম কেন্দ্রস্থল বন্দরনগরীর বহদ্দারহাট মোড়েও ঘটে এ ঘটনা।

একমাত্র সন্তান হৃদয়কে ঘিরেই আবর্তিত হতো রতন ও অর্চনার ভবিষ্যতের সব স্বপ্ন ও আশা। তারা চেয়েছিলেন, অত্যন্ত মেধাবী এই ছেলেটি অনার্স সম্পন্ন করে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সরকারি কর্মকর্তা হবে।

তরুয়া শতাধিক সহযোদ্ধার সঙ্গে বিক্ষোভে যোগ দেন। ৪ জুলাই দুপুর থেকে সন্ধ্যা অব্দি শোলশহর থেকে বহদ্দারহাট পর্যন্ত চলমান উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যে বিকেল ৪টায় পুলিশের সঙ্গে তখনকার ক্ষমতাসীন দলের সশস্ত্র ক্যাডারদের উপর্যুপরি হামলার একপর্যায়ে হৃদয়ের গলায় গুলি বিদ্ধ হয়।

তৎক্ষণাৎ তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (সিএমসিএইচ) নেওয়া হয় এবং অবস্থার অবনতি হলে ঢাকা মেডিকেলে (ডিএমসিএইচ) পাঠানো হয়। পাঁচদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে শেষপর্যন্ত নিভে যায় হৃদয়ের জীবনের আলো, শেষ হয়ে যায় রতন-অর্চনার সব স্বপ্ন।

হৃদয়ের বাবা রতন চন্দ্র তরুয়া ফোনে কথা বলার সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে কাঁপা কণ্ঠে বলেন, ‘আমার ছেলে এসএসসি ও এইচএসসি দুটোতেই জিপিএ-৫ পেয়েছিল। ওর পড়াশোনার খরচ চালাতে আমাকে সীমাহীন কষ্ট করতে হয়েছে। কারণ আমার সামর্থ্য ছিল না।’

কিছুক্ষণ নীরব থেকে ফের বলেন, ‘আমি কত স্বপ্ন দেখেছিলাম! ভেবেছিলাম, আমার ছেলে বড় অফিসার হবে। একদিন আমাদের দারিদ্র্য ঘুচবে।’ আবারও থেমে যান, তারপর বলেন, ‘এখন আমার দিন কাটে ছেলের চিতার পাশে বসে।’

‘বাবা, চিন্তা কোরো না, আর কয়েকটা দিন অপেক্ষা করো। তোমাকে আর কষ্ট করতে হবে না। আমি পরিবারের দায়িত্ব নেব, আমাদের সুখের জন্য কাজ করব’— বাবা-মাকে বলা হৃদয়ের সেই কথাগুলো স্মরণ করে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তার বড় বোন মিতু রানী।

মিতু জানান, হৃদয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার পর বাবা-মায়ের আনন্দের সীমা ছিল না। আত্মীয়-প্রতিবেশীদের মিষ্টি খাইয়েছিলেন তারা।

‘আমার মা পাশের বাড়িগুলোতে গৃহপরিচারিকার কাজ করতেন, কারণ বাবার স্বল্প আয়ে সংসার চলত না। হৃদয় বাবার কাছে টাকা চাইতে লজ্জা পেত, তাই টিউশনি করে নিজের খরচ চালাত’— বলেন মিতু।

হৃদয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সাকিব মাহমুদ রুমী বলেন, ‘বাংলা শব্দ হৃদয় মানে হৃদয়। শহীদ হৃদয় তরুয়া তার বাবা-মায়ের কাছে সত্যিকার অর্থেই হৃদয় ছিলেন। তারা কখনো স্বপ্ন দেখা ছাড়েননি, ভেবেছিলেন ছেলের হাত ধরে তাদের দুঃখের দিন শেষ হবে।’

তরুয়া হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন, সরকারি চাকুরিতে বৈষম্যমূলক কোটাপদ্ধতি তার স্বপ্ন পূরণের পথে অন্যতম বড় বাধা হবে। তবে পুরোপুরি একমত না হয়ে রুমী বলেন, ‘এটা সাধারণ উপলব্ধি হতে পারে। তবে কঠিন বাস্তবতা হলো, হৃদয় তরুয়া এবং তার মতো হাজারো তরুণ, শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ জুলাই-আগস্টের গণজাগরণে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন নিছক ব্যক্তিগত স্বার্থে নয়, বরং অন্যায়-অবিচারের অবসান ও দেশবাসীর অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করার জন্য।’

‘যদি বৈষম্যমূলক কোটাপদ্ধতি বহাল থাকত, তাহলে হয়তো হৃদয় সরকারি চাকুরি পেত না। কিন্তু এই ব্যবস্থার সংস্কারের প্রচেষ্টাই তার জীবন ও স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছে’— বলেন রুমী।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক রাসেল আহমেদ হৃদয় তরুয়াকে আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী হিসেবে স্মরণ করে বলেন, ‘২০২৪ সালের ১৮ জুলাই বহদ্দারহাট এলাকায় মাত্র একটি ঘাতক বুলেট তার দরিদ্র বাবা-মায়ের স্বপ্ন চূর্ণ করে দিয়েছে।’

এখন রতন তরুয়ার একমাত্র চাওয়া, যারা তার ছেলের মতো নিরীহ শিক্ষার্থীদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত হোক।

‘ন্যায়ের পক্ষে আন্দোলন করা কি ভুল? দুর্নীতি, অন্যায় ও অনিয়মের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা কি অপরাধ?’— বেদনার্ত কণ্ঠে প্রশ্ন রাখেন রতন তরুয়া।

শহীদ হৃদয়ের গর্বিত পিতা রতন চন্দ্র তরুয়া  সরকারের প্রতি আকুল আবেদন জানান, যেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার নিজেদের রক্ত দিয়ে জাতির ইতিহাসের নতুন অধ্যায় রচয়িতা শহীদদের পরিবারের পাশে দাঁড়ায় এবং জীবন উৎসর্গ করা মানুষগুলোর আত্মত্যাগ কখনো ভুলে না যায়।

মন্তব্য করুন