বিমান দুর্ঘটনার দিন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম একা তার প্রশিক্ষণ বিমান নিয়ে তিনটি রাউন্ড শেষ করে ল্যান্ড করতে আসবে, এটুকুই হওয়ার কথা ছিলো। ইতোমধ্যে দুই রাউন্ড সম্পন্ন করেছে। কিন্তু তৃতীয় অর্থাৎ শেষ রাউন্ডের সময় তৌকিরের কমান্ডিং অফিসার খেয়াল করল, তৌকির উত্তরা (টঙ্গীর) দিক থেকে আসার সময় হাইট লুজ করছে। অথচ তখন তার ল্যান্ড করার কথা না, ফ্লাই করার কথা।
দৈনিক প্রথম আলোর এক বিশেষ প্রতিবেদনে বিমানবাহিনীর সাবেক সহকারী প্রধান এবং বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এম সানাউল হকের বর্ণনায় বিমান দুর্ঘটনার আগের মুহূর্তের কিছু বিষয় ওঠে আসে।
ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলামের মিশনটা ছিল এ রকম যে সে রানওয়ের ওপর ১৫ থেকে ২০ মিনিট ম্যাক্সিমাম ফ্লাই করবে। ছোট্ট একটা মিশন। যেহেতু এটা ছিল তার প্রথম সলো বা একক ফ্লাইট।
সকালবেলা তৌকির কিন্তু একটা চেক রাইডে গেছে। একটা মিশন করেছে। এটা কে নিয়েছে? এটা তার কমান্ডিং অফিসার নিয়েছে। এটা একটা পরীক্ষার মতো। যখন দেখা গেছে, তৌকির ফিট ছিল, তখন তাকে সলো ট্রিপে পাঠানো হয়েছে।
কমান্ডিং অফিসার কী করে? সে নিজে যেখান থেকে টেকঅফ করবে, ওইটার পাশে এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোলের পাশে একটা মোবাইল হাট, একটা ভ্যানের মতো আছে, সেখানে সেম রেডিও ইকুইপমেন্ট নিয়ে একজন পাইলট সব সময় থাকে। এ রকম গুরুত্বপূর্ণ মিশনে কমান্ডিং অফিসার নিজেই চলে যায় এবং সে সেখানে ছিল। তার কাছে রেডিও থাকে, সবকিছু শুনছে। ইচ্ছা করলে কথাও বলতে পারে। তো সেভাবে সে টেকঅফ করে গেছে।
এই মিশন এ রকম যে ওখান থেকে দেখা যায়। পুরোটা সময়ই সে ভিজিবল (দৃশ্যমান) ছিল। তৌকিরকে পুরোটা সময়ই দেখা গেছে। তার কমান্ডিং অফিসার নিজের চোখে দেখছে। এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোলার দেখছে। সে পাইলট না হোক, অফিসার কমান্ডার নিজে তো পাইলট। সে–ই তাঁকে ক্লিয়ার করছে। সে দেখছে, সবকিছু ঠিকঠাক আছে। ফ্লাইংয়ে কোনো ধরনের সমস্যা নেই।
কিন্তু প্রথম ও দ্বিতীয় রাউন্ড শেষ করে ফাইনাল (তৃতীয়) রাউন্ডে তৌকির যখন তিন থেকে চার কিলোমিটার দূরে তখন কমান্ডিং অফিসারের মনে হলো হাইট লুজ করছে বিমান। এটা বাইনোকুলারে দেখা যায়। তিনি দেখলেন তৌকিরের হাইট পড়ে যাচ্ছে। বিমানটি তখন ১ হাজার ৫০০ ফুট উপরে এবং ১০ সেকেন্ড পার কিলোমিটার স্পিডে ছিলো। যে স্পিড এই বিমানের জন্যে স্বাভাবিক ও খুব লোয়ার সাইডের স্পিড।
প্রশিক্ষণ বিমান আসছে আর কমান্ডিং অফিসার দেখছে, আরে প্লেনটা তো আস্তে আস্তে নিচে নেমে যাচ্ছে।
কিন্তু ওর তো নামার কথা না; ওর তো একই হাইটে যাওয়ার কথা। তখন কমান্ডিং অফিসার তৌকিরকে কল দিয়ে বলল, ‘চেক ইয়োর হাইট।’ ‘চেক ইয়োর হাইট’ বলার পর ‘রজার’ আমরা বলি ‘কপিড’। তখন কমান্ডিং অফিসার ভেবেছে যে তৌকিরের বিমান বোধ হয় ভুলক্রমে নেমে গেছে।
১ হাজার ৫০০ ফুটের জায়গায় ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ ফুটে নেমে গেছে। পরে সে দেখল, আরে, বিমান তো ওপরে উঠছে না, ক্রমাগত নিচে নামছে। তখন তার মনে হলো যে তৌকিরের বিমান তো খুব দ্রুত নামছে। তখন কমান্ডিং অফিসার দুবার তৌকিরকে বলছে, ‘ইজেক্ট ইজেক্ট’। ইজেক্ট হলো প্রতিটি এয়ারক্রাফটে একটা ইজেকশন সিট থাকে। পাইলট ইচ্ছা করলে একমুহূর্তে ইজেক্ট করে বের হয়ে যেতে পারে। এক সেকেন্ডের মধ্যে পাইলট বের হয়ে যেতে পারে।
আমাদের ট্রেনিংটা এ রকম—পাইলট তখনই ইজেক্ট করে, যখন সে মনে করে যে সে এই প্লেনটাকে আর সেফলি ল্যান্ড করতে পারবে না। যখন বিমান ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে বা পাইলট মারা যাচ্ছে, তখন পাইলট যে কাজটা করে, তা হলো, ইজেক্ট। যখন কমান্ডিং অফিসার দেখল যে বিমানটা ডেঞ্জারাস, নিচে নেমে গেছে, তখন ফাইনাল কমান্ড সে নিজে করে বলেছে, ইজেক্ট। দুবার বলেছে ইজেক্ট, ইজেক্ট। কিন্তু ও কোনো রিপ্লাই দেয়নি। তার মানে, পাইলট তখন ব্যস্ত ছিল বিমান নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য এবং এটা অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। আমার জীবনেও এ রকম ঘটনা ঘটেছে। আমি বিমানের কন্ট্রোল নেওয়ায় ব্যস্ত ছিলাম। তারপর যখন দেখলাম, চারদিকে ডাকাডাকি হচ্ছে, তখন উত্তর দিয়েছি। যখন আমি বিমানকে নিয়ন্ত্রণে নিতে পেরেছি, তখন কমান্ডিং অফিসারের মেসেজের উত্তর দিয়েছি। যদি আমি ক্রাশ করে যেতাম, তাহলে তো উত্তর দিতে পারতাম না, কেউ জানত না কী ঘটেছিল ওই সময়!
তাই আমার কাছে মনে হয়েছে, যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে উত্তরায় মাইলস্টোন কলেজের ওপর এই দুঃখজনক বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে। এখানে পাইলটের কোনো গাফিলতি ছিল না বলেই আমার কাছে মনে হয়েছে। অনেকেই না জেনে বলেছেন, বিমান অনেক পুরোনো ও ত্রুটিপূর্ণ।
আমি বলব, বিমান ত্রুটিমুক্ত ও পাইলট ফিট ছিল বলেই তাকে এই সলো ফ্লাইট অপারেট করতে দেওয়া হয়েছিল। এফটি-৭ যুদ্ধবিমান ২০১৩ সালে চীনে তৈরি। খুব বেশি দিন আগের না এসব বিমান।
সবশেষে বলব, দুর্ঘটনার আগে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির চেষ্টা করেছিল বিমান নিয়ন্ত্রণে রাখতে, কিন্তু পারেনি। উল্টো বিধ্বস্ত হয়ে এতগুলো কোমলমতি শিক্ষার্থীর করুণ মৃত্যু হয়েছে। এটাকে নিয়তি হিসেবেই ধরে নিতে হবে!
মন্তব্য করুন