কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার হেলালপুর গ্রামের বাসিন্দা হরেন্দ্র চন্দ্র নাথ। সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষের একটি মিথ্যা মামলায় জীবনের অর্ধেক সময় প্রায় ৪০ বছর কাটিয়েছেন আদালতের বারান্দায়।
বিচারিক আদালত থেকে শুরু করে উচ্চ আদালত—বারবার নিজের পক্ষে রায় পেলেও তার পিছু ছাড়েনি ব্যাংক। ব্যাংক কর্মকর্তার চাকরি হারিয়ে বাস কাউন্টারে টিকিট বিক্রি করেও সংসার চালিয়েছেন। তারপরও মামলা থেকে রেহাই পাননি ৮০ বছর বয়সী এ মানুষটি।
অবশেষে মিথ্যা অভিযোগের মামলায় ব্যাংকের পিছু হটার ব্যবস্থা হলো দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ে। এতে ৪০ বছর আইনি লড়াইয়ের পর ভারমুক্ত হলেন সোনালী ব্যাংকের এক সময়ের কর্মকর্তা ৮০ বছর বয়সী হরেন্দ্র নাথ।
অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ১৯৮৫ সালে চাকরি হারানো হরেন্দ্র চন্দ্র নাথকে মামলা পরিচালনার খরচ হিসেবে সোনালী ব্যাংককে ২০ লাখ টাকা দিতে নির্দেশ দিয়েছেন আপিল বিভাগ। আগামী তিন মাসের মধ্যে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে এ টাকা পরিশোধ করতে বলা হয়েছে।
তার বিরুদ্ধে করা ব্যাংকের রিভিউ আবেদন খারিজ করে বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ এ আদেশ দেন। এর ফলে মামলা পরিচালনার খরচ হিসেবে তিন মাসের মধ্যে সোনালী ব্যাংককে হরেন্দ্র নাথকে ২০ লাখ টাকা দিতে হবে। আদালতে হরেন্দ্র নাথ চন্দ্রের পক্ষে (বিনামূল্যে সরকারি আইনি সেবায় নিযুক্ত) শুনানি করেন আইনজীবী ব্যারিস্টার ওমর ফারুক।
এর আগে গত ৯ ডিসেম্বর এ মামলায় আপিল বিভাগ একই রায় দিয়েছিলেন। পরে রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ করে সোনালী ব্যাংক। ওই রিভিউ শুনানি নিয়ে রায় দেন সর্বোচ্চ আদালত।
রায়ের পর ব্যারিস্টার ওমর ফারুক সাংবাদিকদের জানান, বিচারিক আদালতের রায় থেকে শুরু করে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত হরেন্দ্র নাথ নির্দোষ প্রমাণিত হলেন। আমাদের দেশে যে কেউ এসে মামলা করে, মানুষকে মিথ্যা মামলা বা ভুয়া মামলা দিয়ে হয়রানি করে। এ রায় তাদের জন্য একটা সতর্কবাণী। এ রায়ের ফলে উনি চাকরির দায়দেনার জন্য হাইকোর্টে যে রিট করেছিলেন সেটা চলতে আর কোনো বাধা রইলো না।
এ আইনজীবী বলেন, আমরা বলে আসছি যেসব ব্যাংক বা যারা মানুষকে হয়রানি করে, নাগরিককে হয়রানি করে এবং কর্মচারীদের হয়রানি করে তাদের বিরুদ্ধে জরিমানা করলে মামলা কমবে এবং হয়রানি কমবে। আমি আইনজীবী হিসেবে মনে করি, সোনালী ব্যাংকসহ যারা তাদের কর্মচারীদের সিরিজ সিরিজ মামলা দিয়ে হয়রানি করে এটিরও অবসান হবে।
১৯৮৫ সালে ১৬ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ব্যাংক কর্মকর্তা থাকার সময় ৯ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়। সেই মামলার একজন বিবাদী ৮০ বছর বয়সী হরেন্দ্র নাথ চন্দ্র। দীর্ঘ ৪০ বছর আইনি লড়াই শেষে মিথ্যা অভিযোগ থেকে ভারমুক্ত হলেন তিনি।
ব্যারিস্টার ওমর ফারুক জানান, ৮০ বছর বয়সী এ বৃদ্ধ অবশেষে ভারমুক্ত হলেন। ১৯৮৫ সালের একটি ঘটনায় তিনি জেলও খেটেছেন। এরপর সব আদালতেই তিনি জয়ী হয়েছেন। তবে প্রতিটি ধাপেই ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আপিল করেছে। আপিল বিভাগে সর্বশেষ আপিলেও জয়ী হন হরেন্দ্র নাথ।
তিনি বলেন, আমাদের আর্জিতে সর্বোচ্চ আদালত তিন মাসের মধ্যে ২০ লাখ টাকা মামলা পরিচালনার ব্যয় হিসেবে দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে এ আদেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে।
এ আইনজীবীর তথ্য মতে, হরেন্দ্র নাথ চন্দ্র কুষ্টিয়ার খোকসার হেলালপুর গ্রামের বাসিন্দা। বিএ পাস করে ১৯৭৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর ক্যাশিয়ার-কাম ক্লার্ক পদে সোনালী ব্যাংক ঢাকার একটি শাখায় যোগদান করেন। এর তিন বছর পর পদোন্নতি পেয়ে সিনিয়র ক্যাশিয়ার-কাম ক্লার্ক হন। এরপর তাকে যাত্রাবাড়ী শাখায় বদলি করা হয়।
তিনি চাকরিরত অবস্থায় রেমিট্যান্স সংক্রান্ত ১৬ লাখ ১৬ হাজার ১০০ টাকা যাত্রাবাড়ী শাখা থেকে লোকাল অফিসে স্থানান্তর করা হয়। সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তা সিল-স্বাক্ষরসহ লিখিতভাবে সমুদয় অর্থ বুঝে নেন। তবে এর কিছুদিন পর ১৯৮৫ সালে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ তদন্তে ওই টাকা পাওয়া যায়নি বলে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।
পরবর্তী সময়ে তহবিল তছরুপের অভিযোগে ১৯৮৫ সালের শেষ দিকে হরেন্দ্র নাথসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। এ অভিযোগে ১৯৮৬ সালের মার্চে তাদের সবাইকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
গ্রাহকের টাকা জমা না দেওয়ার অপর একটি মামলায় ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে সাবেক এ ব্যাংক কর্মকর্তাকে ৭ বছর কারাদণ্ড দেন বিচারিক আদালত। পাশাপাশি অন্যদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। একপর্যায়ে ১৯৯০ সালে হরেন্দ্র নাথ জেল খেটে বের হন।
১৯৮৫ সালের ২৯ জুলাই হরেন্দ্র নাথসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ঢাকার বিশেষ আদালতে ফৌজদারি মামলা করে তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরো। বিচারে ১৯৮৬ সালের ১৫ নভেম্বর হরেন্দ্র নাথসহ সবাই বেকসুর খালাস পান।
মামলায় পরাজিত হয়ে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ১৯৮৮ সালে হরেন্দ্রসহ সবার বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে মামলা করে। সে মামলায় একতরফা রায়ে তাদের দোষী সাব্যস্ত করে সমুদয় অর্থ ফেরত দেওয়ার আদেশ দেন আদালত। পরে এর বিরুদ্ধে আবেদন করেন হরেন্দ্র নাথ।
১৯৯২ সালের ১৯ আগস্ট ঢাকার যুগ্ম জেলা জজ আদালত আপিল গ্রহণ করেন এবং একই সঙ্গে বিচারিক আদালতের আদেশ বাতিল করেন। এরপর ওই রায়ের বিরুদ্ধে সোনালী ব্যাংক ২০১৯ সালে হাইকোর্টে আপিল করে। ২০২২ সালের ২৯ আগস্ট এ আপিল খারিজ করে রায় দেন উচ্চ আদালত। এর মধ্যে মামলার সব আসামি বিভিন্ন সময়ে মারা গেলেও একমাত্র বেঁচে আছেন হরেন্দ্র নাথ।
সবশেষ গত বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করেন সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। সেটিও দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে খারিজ হওয়ার পর আপিল বিভাগের রায় পুর্নবিবেচনার আবেদন করে ব্যাংক। রিভিউ খারিজ হওয়ায় নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার পাশাপাশি অভিযোগ থেকে ভারমুক্ত হলেন ৮০ বছর বয়সী হরেন্দ্র চন্দ্র নাথ।
মন্তব্য করুন