ইটালির ওলক্স শহর থেকে শুরু করে ফ্রান্সের ব্রিয়ন্সো পর্যন্ত আল্পস পর্বতমালার দুই প্রান্তে অবস্থিত অভিবাসী আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে মে মাসে হঠাৎ করেই নতুন আসা অভিবাসীদের চাপ বেড়েছে। আশ্রয়কেন্দ্র পরিচালনাকারী সংস্থাগুলোর আশঙ্কা আসন্ন গ্রীষ্মে পরিস্থিতি আরো গুরুতর হতে পারে৷
ইটালি-ফ্রান্স সীমান্তের হউত-আল্পস অঞ্চলে মে মাসে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে অভিবাসীদের আগমনের হার হঠাৎ করে কয়েকগুণ বেড়ে গেছে৷ সাধারণত গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময়ে এমন ভিড় দেখা যায়, কিন্তু এবার তা মে মাসেই দেখা দিয়েছে৷
ওলক্সের ‘ফ্রাতেরনিতা মাসি’ নামের আশ্রয়কেন্দ্রটি মে মাসে এক হাজার ৬৮৭ জন অভিবাসীর আগমন নথিভুক্ত করেছে৷ সংখ্যাটি ২০২৪ সালের মে মাসে ছিল মাত্র ৩৬৯ জন৷ আগের বছরের তুলনায় এই বৃদ্ধির হার প্রায় ৩৫৭ শতাংশ৷ ২০২৩ সালের মে মাসে এই সংখ্যাটি ছিল ৮৭৬৷
কেন্দ্রটির স্বেচ্ছাসেবক সিলভিয়া মাসারা ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, ‘‘এপ্রিল থেকে ধীরে ধীরে সংখ্যা বাড়তে থাকে, মে মাসে তা ভয়াবহ আকার নেয়৷ একদিনে ১৩০ জন নতুন অভিবাসী আসার ঘটনা ঘটেছে, যেখানে সাধারণত দৈনিক সংখ্যা ৩০ জনের মতো থাকে৷’’
এক মাসে আটক এক হাজার
হউত-আল্পসের প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ ইনফোমাইগ্রেন্টসকে নিশ্চিত করেছে, মে মাসে ফ্রান্স-ইটালি সীমান্ত অতিক্রমের চেষ্টাকালে এক হাজার ৪ জন অনিয়মিত অভিবাসীকে আটক করা হয়েছে৷ যাদের মধ্যে ৪২৫ জন প্রাপ্তবয়স্ক এবং ৫৭৯ জন ছিলেন অভিভাবকহীন শিশু৷ ২০২৪ সালের একই সময়ে এই সংখ্যা ছিল ২৯১ জন৷
২০২৫ সালের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত মোট দুই হাজার ৬৩৪ জন অভিবাসী সীমান্ত থেকে আটক হয়েছেন৷ যাদের মধ্যে এক হাজার ৪৩৭ জন প্রাপ্তবয়স্ক এবং এক হাজার ১৯৭ জন অভিভাবকহীন শিশু রয়েছেন৷
সীমান্তবর্তী ফরাসি শহর ব্রিয়ন্সোতে অবস্থিত ‘রেফুজ সলিডেয়ার’ নামের একটি সংস্থা ‘লে তেরাস সলিডেয়ার’ নামের একটি অভ্যর্থনাকেন্দ্র পরিচালনা করে৷
সংস্থাটির মুখপাত্র এমিল রাবরু জানান, ২০২৫ সালের প্রথম তিন মাসে তাদের কাছে আশ্রয় চাওয়া মানুষের সংখ্যা গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণ হয়েছে৷
ওলক্সের কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, মে মাসে আগতদের ৮২ শতাংশ ইরিত্রিয়ান এবং ইথিওপিয়ান৷ তাদের মধ্যে ৩৩ শতাংশ অভিভাবকহীন শিশু। অনেক নারী ও শিশু এবং প্রায় প্রতিদিনই ৩০ জনের মতো শিশু একাই কেন্দ্রটিতে পৌঁছাচ্ছেন৷
অধিকাংশ অভিবাসী লিবিয়া থেকে নৌপথে লাম্পেদুসায় এসে, এরপর ইটালির মধ্য দিয়ে পায়ে হেঁটে আল্পস পর্বত পার হয়ে ফ্রান্সে ঢোকার চেষ্টা করেন৷ কেউ মঁজনেভ নামের সীমান্ত রুট (১৮৫০ মিটার উচ্চতা) দিয়ে, কেউবা আরো দুর্গম এলাকা হয়ে এই ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা করে৷ অনেকেই শারীরিক ও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত অবস্থায় কেন্দ্রে পৌঁছান৷
বছরের পর বছর ধরে সীমান্ত এলাকায় পুলিশের উপস্থিতি বেড়ে যাওয়ায় অভিবাসীরা বিপজ্জনক পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন৷
২০১৮ সালে নাইজেরিয়ান নাগরিক ব্লেসিং ম্যাথিউ এই পার্বত্য পথ পার হতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন৷ তার মৃত্যুর সঠিক কারণ আজও অজানা৷ ২০২৩ সালের আগস্টে এক অভিবাসীর লাশ উদ্ধার হয় যার হাঁটুতে ছিল ছেঁড়া দাগ৷ গ্রীষ্মেও অনেক দুর্ঘটনা ঘটে৷
অর্থ সংকটে আশ্রয়কেন্দ্রগুলো
ওলক্সের কেন্দ্রটি ৮০ জনকে অস্থায়ীভাবে জায়গা দিতে পারে৷ চাপ সামলাতে অনেক সময় মেঝেতে বিছানা পাততে হয়৷ ব্রিয়ন্সোতে তো আশ্রয় দেওয়ার জন্য ছাদে তাবু পর্যন্ত টানানো হয়েছে৷
‘‘তারা অনেকেই শুধু খালি পায়ে এসে থাকেন৷ আমাদের প্রথম চিন্তা থাকে তাদেরকে জুতা দিতে হবে,” বলেন স্বেচ্ছাসেবক সিলভিয়া৷
অন্যদিকে, আশ্রয়কেন্দ্রগুলো চরম আর্থিক সংকটে আছে৷ সিলভিয়া জানান, “২০২৪ সালটি খুবই কঠিন ছিল আমাদের জন্য৷ এখন অবস্থার আরো অবনতি হয়েছে৷ নতুন মেয়র ডানপন্থি হওয়ায় আমাদের কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টাও হচ্ছে৷’’
বর্তমানে এই কেন্দ্রটি বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে বুসোলিন এলাকার ধর্মযাজক দোন লুইজি কিয়াম্পোর, বারদোনেকিয়া শহরের সহায়তা এবং কিছু ব্যক্তির অনুদানের কারণে৷
ব্রিয়ন্সোতে থাকা ‘রেফুজ সলিডেয়ার’ও একই সমস্যায় পড়েছে৷ এমিল রাবরু বলেন, ‘‘গত দুই মাসে আমরা বড় ধরনের তহবিল সংকটে পড়েছি৷ আমাদের নির্ভরশীল ফাউন্ডেশনগুলো বাজেট কমিয়ে দিয়েছে৷ আমরা জানি না ভবিষ্যতে কাজ কীভাবে চালিয়ে যাব৷’’
ইতিমধ্যে কর্মী সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনতে হয়েছে৷ ২০২৪ সালে নিবন্ধিত ৬০০ জন স্বেচ্ছাসেবকের সহায়তা এবং সাধারণ মানুষের দানেই টিকে আছে প্রতিষ্ঠানটি৷
এমিল রাবরু বলেন, ‘‘আমরা না থাকলে এই মানুষগুলো রাস্তায় পড়ে থাকতেন৷’’
মন্তব্য করুন