শ্বাসকষ্টের রোগী ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার কলেজপাড়া এলাকার বাসিন্দা মো. বাবুল মিয়া (৫৪)। শুক্রবার হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হলে স্বজনরা তাকে রাজধানীর মিরপুরে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালে ভর্তি করেন। চিকিৎসকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে হার্টের সমস্যার সঙ্গে কোভিড-১৯ পজিটিভ আক্রান্ত রোগী হিসাবে শনাক্ত করেন।
করোনাভাইরাস ফুসফুসে আক্রমণ করায় নিউমোনিয়া হয়েছে জানিয়ে হার্টের আগে জরুরি ভিত্তিতে নিউমোনিয়ার চিকিৎসার কথা বলেন তারা। একই সঙ্গে দ্রুত নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) স্থানান্তরের পরামর্শ দেন। এমন খবরে বাবুল মিয়ার স্বজনরা দিশেহারা হয়ে পড়েন। আইসিইউ’র জন্য বেসরকারি এভারকেয়ার ও ইউনাইটেড হাসপাতালে যোগাযোগ করেন। সেখানে করোনাভাইরাস পজিটিভ রোগীর জন্য পৃথক আইসিইউ নেই বলে জানানো হয়।
নিরূপায় স্বজনরা শনিবার সকাল ১১টায় মহাখালী ‘ডিএনসিসি কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতালে’ আইসিইউতে ভর্তির ব্যবস্থা করেন। কিন্তু ভাগ্য সহায় হয়নি। আইসিইউতে ঢোকানোর আগেই বাবুল মিয়ার মৃত্যু হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে বাবুল মিয়ার মৃত্যুর এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা যুগান্তরকে বলেছেন, করোনাভাইরাস মূলত শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে এবং ফুসফুসে আক্রমণ করে। এর ফলে ফুসফুসে প্রদাহ হতে পারে, যা নিউমোনিয়ার মতো অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে।
কিছু ক্ষেত্রে এই সংক্রমণ মারাত্মক আকার ধারণ করে এবং এআরডিএস (একিউট রেসপিরেটিরি ডিসট্রেস সিনড্রোম) নামে পরিচিত একটি অবস্থার দিকে যেতে পারে। এভাবে ফুসফুস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং শরীরে অক্সিজেনের অভাব দেখা দেয়। এমনকি যাদের আগে থেকে ফুসফুস সম্পর্কিত কোনো সমস্যা ছিল না, তারাও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে ফুসফুসের জটিলতায় ভুগতে পারেন।
বিশেষজ্ঞরা তাদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে ফুসফুসে সংক্রমণ হলে কিছু সাধারণ লক্ষণ দেখা যেতে পারে। যেমন-জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট, দুর্বলতা, পেশিব্যথা, স্বাদ ও ঘ্রাণ চলে যাওয়া। কিছু ক্ষেত্রে সংক্রমণ গুরুতর হলে নিউমোনিয়া বা এআরডিএস-এর মতো অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।
যা জীবনের জন্য হুমকি। টিবি কন্ট্রোল অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের তত্ত্বাবধায়ক (চলতি দায়িত্ব) বক্ষব্যাধি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. ফাতেহ আকরাম দোলন বলেন, কোভিডের কারণে ভাইরাল নিউমোনিয়া অর্থাৎ করোনাভাইরাসজনিত নিউমোনিয়া হয়। যাকে কোভিড নিউমোনিয়া বলে। এর ফলে ফুসফুসে ফ্রাইবোসিস হয়, কাশি ও শ্বাসকষ্ট হয়। ফুসফুসে পানিও জমতে পারে। ফুসফুসে অক্সিজেন সরবরাহের ক্ষমতা কমে যায়। পরে রেসপিরেটরি ফেউলিওর হয়ে রোগীর আইসিসিইউ সাপোর্টের প্রয়োজন হতে পারে।
করোনাভাইরাস থেকে ফুসফুস সুরক্ষিত রাখার বিষয়ে তিনি বলেন, ফুসফুসের মধ্যে জীবাণু প্রবেশ করলেই অঙ্গটির স্বাভাবিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়। তাই করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধ বা যে কোনো পরিস্থিতিই হোক ফুসফুস সুরক্ষিত রাখতে মাস্ক পরা জরুরি। এতে ফুসফুসে ধুলাবালি, ধোঁয়া এবং জীবাণু সহজে প্রবেশ করতে পারবে না।
অল্প পরিমাণে প্রবেশ করলেও ফুসফুসের ইমিউনিটি সিস্টেম সেটি প্রতিরোধ করতে পারবে। দ্বিতীয়ত, ধূমপান পরিহার করতে হবে। তৃতীয়ত, অ্যান্টি অক্সিডেন্ট তথা ফলমূল ও লেবুজাতীয় খাবার খেতে হবে। পাশাপশি পর্যাপ্ত পানি পান এবং নিয়মিত শরীরচর্চা (ব্যায়াম বা দৌড়ানো) করতে হবে। এগুলো করোনাভাইরাস আক্রান্তের আগের কাজ। এরপরও কেউ আক্রান্ত হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শে এক্স-রে ও ওষুধ খেতে হবে।
২৪ ঘণ্টায় ৭ রোগী শনাক্ত : এদিকে শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে আরও ৭ জনের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার তথ্য দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ নিয়ে চলতি বছর শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল ২৬২ জনে। এদের মধ্যে ১০৪ জন শনাক্ত হয় চলতি জুন মাসে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, শনিবার সকাল থেকে আগের ২৪ ঘণ্টায় ১৩৯টি নমুনা পরীক্ষা করে সাতটিতে করোনাভাইরাস পাওয়া যায়। শনাক্তের হার ৫ দশমিক ০৪ শতাংশ। ১৩৯টির মধ্যে ঢাকায় ৮৪টি নমুনা পরীক্ষা করে ৪ জনের এবং চট্টগ্রামে ৫৪টি নমুনা পরীক্ষা করে তিনজনের করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়।
দেশে ২০২০ সালে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর থেকে শনিবার পর্যন্ত ১ কোটি ৫৭ লাখ ২৬ হাজার ৯৩৩টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে করোনাভাইরাস পাওয়া যায় ২০ লাখ ৫১ হাজার ৮০৭টি নমুনায়। মৃত্যু হয় ২৯ হাজার ৫০২ জনের। মহামারি শুরুর প্রথম বছর ২০২০ সালে ৭ হাজার ৫৫৯ জনের প্রাণ কেড়ে নেয় করোনাভাইরাস। এরপর সবচেয়ে বেশি ২০ হাজার ৫১৩ জনের মৃত্যু হয় ২০২১ সালে। ২০২২ সালে ১ হাজার ৩৬৮ জন, ২০২৩ সালে ৩৭ জন ও ২০২৪ সালে ২২ জনের মৃত্যু হয় প্রাণঘাতী এ ভাইরাসে।
প্রসঙ্গত, ভারতসহ পাশের কয়েকটি দেশে করোনাভাইরাসের নতুন সাব-ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় এবং অন্যান্য দেশে ধরনটি ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় নতুন সতর্কতা জারি করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
সোমবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ভারত এবং ভাইরাস ছড়ানো অন্যান্য দেশে ভ্রমণ থেকে বিরত থাকতে বলেছে। পাশাপাশি ঝুঁকি মোকাবিলায় সব স্থল ও বিমানবন্দরে হেলথ স্ক্রিনিং ও নজরদারি বাড়াতে বলা হয়েছে।
মন্তব্য করুন