অন্যের বাবাকে দেখেই ফালাহ বোঝে, ‘বাবা’ বলতে কী বোঝায়।
চোখে চশমা, মাথায় টাক, বয়সের ছাপ পড়া দাড়ি-গোঁফ—এভাবেই ধীরে ধীরে তার কল্পনায় গড়ে ওঠে নিজের বাবার মুখ।
অন্যের মায়ের কাছে গিয়ে সে কল্পনা করে, মায়ের গন্ধটা হয়তো এমনই। মায়েরা উদ্বিগ্ন হন, সন্তানের জন্য অপেক্ষা করেন দরজায় দাঁড়িয়ে।
কিন্তু কে ছিল তার বাবা? কী ছিল তার নাম? মায়ের কণ্ঠস্বর কেমন ছিল? তার ভাইবোন কে ছিল? তাদের সঙ্গে শিশুকালটা কেমন ছিল, শৈশবটা কেমন হতো?
এসব প্রশ্নের উত্তর নেই ফালাহর কাছে। সে কিছুই জানে না। সবই ধোঁয়াটে, কল্পনার ফ্রেমে আঁকা মুখ, শূন্য ক্যানভাসের মতো।
মামা, চাচা, খালা—সব আত্মীয়স্বজনের সংজ্ঞা, সম্পর্ক, অনুভূতি সবই ফালাহ শিখেছে বই পড়ে কিংবা ইন্টারনেট ঘেঁটে।
ফালাহ জানে না তার জন্মদিন, জানে না জন্মঘরের ঠিকানা! এমনকি তার নামটা কে রেখেছিল, তা–ও অজানা। এটা ইরাকি তরুণ ফালাহর হিমশীতল জীবনকাহিনি।
জন্মের কয়েক সপ্তাহের মাথায় বোমা হামালায় ফালাহর পুরো পরিবারসহ ঘরবাড়ি মাটির সঙ্গে মিশে যায়। অলৌকিকভাবে বেঁচে যায় সে।
ফালাহ যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার হওয়া সব হারানো এক শিশু।
পরিবারের কেউই বেঁচে না থাকায় এক চ্যারিটির সহায়তায় তার ঠাঁই হয় সিরিয়ার একটি শরণার্থীশিবিরে। সেখানেই তার বেড়ে ওঠা। এরপর দালালের হাত ধরে, বহু পথ ঘুরে তুরস্ক হয়ে ব্রিটেনে প্রবেশ। এর পর থেকে শরণার্থীজীবন, নিঃসঙ্গতা ও আশ্রয়হীন পথচলা।
লন্ডনে এসে কিছুদিন রাস্তায় কাটাতে হয় ফালাহকে। তারপর চার্চের এক পাদরির সহায়তায় বিখ্যাত চ্যারিটি সংস্থা স্যালভেশন আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ এবং সেখান থেকে মডার্ন স্ল্যাভারি অ্যান্ড হিউম্যান ট্রাফিকিং প্রজেক্টের অধীন পুনর্বাসনের উদ্যোগ।
ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, তথা হোম অফিসের আউটসোর্সিং প্রজেক্ট মডার্ন স্ল্যাভারি অ্যান্ড হিউম্যান ট্রাফিকিং প্রজেক্টে কাজ করা অবস্থায় আমি ফালাহর কাহিনিটি আবিষ্কার করেছিলাম। কাহিনিটি তার ‘কেস নোটে’ এলোমেলোভাবে উল্লেখ ছিল। পরে পেশাগত আলাপে সামনে আসে তার জীবনের হিমশীতল কাহিনি। প্রতিষ্ঠানটি থেকে গত মাসে বিদায় নিয়েছি।
কর্মরত অবস্থায় অনেকের মতো আমার দায়িত্ব ছিল যুদ্ধসহ নানা কারণে ব্রিটেনে পাচার হয়ে আসা অসহায় মানুষদের সহায়তা করা। সব ধরনের ট্রমা বা মানসিক সমস্যা কাটিয়ে তারা যাতে সমাজে সুস্থভাবে পুনর্বাসিত হতে পারে, এর উদ্যোগ নেওয়া এবং কেউ যাতে তাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বিপথে পরিচালনা করতে না পারে, অথবা কোনো ধরনের নির্যাতন করতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখা।
ফালাহকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে তার আশ্রয়ের আবেদনের জন্য লিগ্যাল এইড (সরকারি খরচে পরিচালিত) সলিসিটার (আইনজীবী) নিয়োগ, ইংরেজি শিক্ষা কোর্সে ভর্তি, আবাসনের ব্যবস্থা, চাকরির প্রশিক্ষণ, ডাক্তার রেজিস্ট্রেশন, মেন্টাল হেলথে রেফার ইত্যাদির ব্যবস্থা আমরা করি। সঙ্গে চলার জন্য আমরা তাকে সাপ্তাহিক ভাতাও দিতাম, যা মূলত হোম অফিস থেকেই আসত।
এ ছাড়া গৃহহীনদের জন্য নির্ধারিত একটি হোস্টেলে তার আবাসনের ব্যবস্থাও আমরাই করে দিয়েছিলাম।
ফালাহ বলছিল, সে জানে না ইরাকের কোন শহরে, কোন ঠিকানায় তার জন্ম। শুধু একজনের কাছে শুনেছিল, জন্মের কিছুদিন পরই বোমা বিস্ফোরণে তার পুরো বাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়। পরিবারের সবাই ঘটনাস্থলেই মারা যান।
ফালাহ বিষণ্নতা রোগে আক্রান্ত ছিল। ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কথা বললেই কেঁদে ফেলত। বিশেষ করে ইমিগ্রেশনের বিষয়টি ঝুলে থাকায় সব সময় মন খারাপ করে থাকত। তার ইংরেজিও ভালো ছিল না। আত্মীয়হীন, বন্ধুহীন, রাষ্ট্রহীন, পরিচয়হীন জীবনের ভার যে ফালাহ নিতে পারছিল না, তা বুঝতে পারছিলাম আমি।
একদিন নিয়মিত ‘ওয়েলফেয়ার চেক’ করার সময় সে কাঁদতে কাঁদতে বলল, তার আর বাঁচতে ইচ্ছা করে না। সত্যিকার অর্থে আত্মহত্যার ইচ্ছার কথা জানায়। আত্মহত্যার এই প্রবণতা এমন মানুষদের সুরক্ষার ক্ষেত্রে গুরুতর সমস্যা। আমাকে সঙ্গে সঙ্গে সংগঠনের নীতি অনুসারে নিরাপত্তামূলক নানা ব্যবস্থা নিতে হয়েছিল।
এর বাইরে মানবিক বিবেচনায় অফিসকে জানিয়ে তার ইমিগ্রেশনের বিষয়টিকে আমি ব্যক্তিগতভাবে ডিল করতে শুরু করি। তাকে সঙ্গে নিয়ে দেখা করি তার সলিসিটারের সঙ্গে। তখনই বুঝলাম, ভাষাগত সমস্যার কারণে সে তার কেসটিকে যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেনি। তার হয়ে আমি নিজেই তার জীবনকাহিনির খসড়া করে ‘পারসোনাল স্টেটমেন্ট’ আকারে সলিসিটারকে দিই।
তার বিষয়টিকে জোরদার করার জন্য মানসিক স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সব চিকিৎসা সনদও সংগ্রহ করি। তার ওয়েলফেয়ার দেখভালকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হিসেবে সবিস্তারে লেখা আমার বিশেষ চিঠিও এর সঙ্গে সংযুক্ত করি। আমার অনুরোধে ফালাহর হোস্টেল ব্যবস্থাপকও একটি চিঠি লিখে দেন। সবশেষে নিয়ে যাই স্থানীয় সংসদ সদস্যের কাছে। তিনিও একটি শক্তিশালী চিঠি লিখে দেন। সবই জমা দেওয়া হয় ফালাহর সলিসিটারের কাছে।
অবশেষে ৯ মাসের মাথায় হোম অফিস থেকে তার কাছে একটি চিঠি আসে—‘Indefinite Leave to Remain’—ব্রিটেনে স্থায়ী বসবাসের অনুমতি।
ফালাহ বুঝতে পারেনি, এতে কী লেখা। আমি পড়ে তাকে জানাই, সে আর রাষ্ট্রহীন নয়। সঙ্গে সঙ্গে সে কান্নায় ভেঙে পড়ে!
তার ইমিগ্রেশনের বিষয়টি দ্রুততার সঙ্গে সমাধানের জন্য সার্ভিস হেডের কাছ থেকে ই-মেইলে বিশেষ ধন্যবাদ পেলাম আমি। ব্যবস্থাপকের কাছ থেকেও ধন্যবাদ পাই। উদাহরণ হিসেবে টিম মিটিংয়েও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়।
এরপর সবকিছু দ্রুত এগোতে থাকে। বেনিফিটের জন্য আবেদন, স্থায়ী আবাসন, চাকরির ট্রেনিং—সবই সম্পন্ন হয় ধাপে ধাপে।
এরই মাঝে আমাকে অবাক করে দিয়ে একটি শিশা বারে ফুলটাইম কাজ পাওয়ার সুখবর দেয় ফালাহ।
পুনর্বাসনের এসব অগ্রগতি শেষ হওয়ার পরই হোম অফিসের নিয়মমাফিক ১৪ দিনের নোটিশে তাকে আমাদের সার্ভিস থেকে বিদায় নিতে হয়।
সার্ভিস থেকে বিদায়ের দিন আমার সঙ্গে দেখা করতে অফিসে এসেছিল ফালাহ। টেমসের মিলেনিয়াম ব্রিজের কাছেই ছিল আমার অফিস। তাকে নিয়ে বের হয়ে একটা কফিশপে বসে শেষবারের মতো অনেকক্ষণ কথা বললাম।
বেশ কিছু সমস্যার দ্রুত সমাধানের কারণে দেখলাম, তার মধ্যে একধরনের আত্মবিশ্বাস জন্মেছে, যা দেখে ভালো লাগছিল।
বিদায়বেলা আমাকে জড়িয়ে ধরে সে কেঁদে ফেলে, ‘আপনি সাহায্য না করলে আমি আজ বেঁচে থাকতে পারতাম না।’ বারবার বলছিল, ‘ধন্যবাদ।’ জিজ্ঞেস করেছিলাম, কখনো কি ইরাক যাবে? সরাসরি উত্তর না দিয়ে পাল্টা জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কোনোভাবে কি জানা সম্ভব, আমার শহর কিংবা গ্রামের নামটা কী?’
আমি কোনো উত্তর দিতে পারিনি। ভিড়ের মধ্যে ফালাহ একসময় হারিয়ে যায়!
ফিরছিলাম অফিসে—টেমস নদীর পাড় ধরে হেঁটে। টের পাচ্ছিলাম, পেশাগত কারণে যে বিষাদকে এত দিন চেপে রেখেছিলাম, তা–ই এখন বুদ্বুদের মতো ঝাঁকুনি দিচ্ছে। একদিকে বন্ধন ছিন্নের বেদনা, অন্যদিকে সব হারানো ফালাহর শূন্য জীবনের গল্প—দুটিই বুকের মধ্যে দলা পাকিয়ে ফেনিয়ে উঠতে লাগল। মনে হচ্ছিল, কোথাও কেউ তাকে (ফালাহ) জন্ম দেয়নি! নিজের ভেতর থেকেই জন্ম নিয়ে সে পৃথিবীতে এসেছে!
কারও কারও কাছে জীবন কি তবে এমনিই নিষ্ঠুর! নির্দয়!
আমি জানি, সমুদ্রের বিরামহীন ঢেউয়ের মতোই এ দুঃখ আছড়ে পড়তে থাকবে ফালাহর জীবনে, নীরবে বা সরবে!
দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল প্যালেস অব ওয়েস্টমিনস্টারের চূড়া।
ভাবছিলাম, ওই ভবন থেকেই তো একদিন যুদ্ধের সিদ্ধান্ত এসেছিল, যে যুদ্ধের আগুনে ছারখার হয়েছিল ফালাহ নামের এক নবজাতকের ঘর, তার পরিবার।
এক মহাধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে এসে এক শিশু আজ তরুণ বয়সে এই ভবনের ছায়াতেই হাঁটছে শূন্য হাতে, নতুন জীবনের পথে।
সাধারণ তথ্য সুরক্ষা বিধি (জিডিপিআর) অনুযায়ী ফালাহর মতো সেবাগ্রহণকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য রাখা অপরাধ। এ কারণে ফালাহর ফোন নম্বরসহ অন্য কোনো তথ্যই আমার কাছে নেই। তার সঙ্গে আমার আর কোনো দিনই হয়তো দেখা হবে না। কিছুদিন পরই যোগ দেব নতুন কর্মস্থলে।
কিন্তু আমার অর্ধশতকের জীবনে কিংবা কর্মসূত্রে অসংখ্য খণ্ড-অখণ্ড পরিচয়ের ভিড়ে ফালাহর এই মহাশূন্যতার গল্প রয়ে গেছে! পথের ভুলে পরিচয় হয়ে যাওয়া এ গল্প থেকে যাবে!
আলোঝলমলে লন্ডন শহর! এই শহরের উচ্ছ্বসিত প্রাণের রাজ্য আর বিস্তৃত কলরব কি পারবে ফালাহর অতল শূন্যতাকে ঘুচিয়ে দিতে? বিদায়বেলা তার শূন্য নিবিষ্ট দৃষ্টির মধ্যে যে নিবিড় বেদনা দেখেছিলাম, তাকে কেবল এক হতভাগার কান্না ভাবলে ভুল হবে। এ কান্নার অশ্রু যে অভিশাপ।
কথাশিল্পী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কেবল ‘ভদ্র পল্লিতে’ ঈশ্বরকে খুঁজে পেয়েছিলেন।
ওয়েস্টমিনস্টার ব্রিজের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমি খুঁজছিলাম লন্ডন ও ওয়াশিংটনের ‘ঈশ্বর’দের, যারা নবজাতকের মাথার ওপর আকাশ ধসে পড়ার সময় চোখ বন্ধ করে থাকেন। একবার নয়, বারবার!
(বি.দ্র.: এই তরুণের ছদ্মনাম দিয়েছি ফালাহ। জিডিপিআরের কারণে তার প্রকৃত নাম ও ছবি ব্যবহার করিনি।)
* সৈয়দ মনসুর উদ্দিন: লন্ডনে একটি আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থায় কর্মরত
uddin14 [email protected]
মন্তব্য করুন