রবিবার, ০৩ আগস্ট ২০২৫, ১৯ শ্রাবণ ১৪৩২

রাজধানী ঢাকায় বিমান বিধ্বস্ত: হারালাম শিশুর হাসি

ওমর ফারুক হিমেল
  ২৩ জুলাই ২০২৫, ১৪:৪৪
ছবি-সংগৃহীত

একটা দেশ যেখানে দুর্ঘটনা জীবনকে সযত্নে ফিরিয়ে দেয়। আরেকটা দেশ যেখানে একটি দুর্ঘটনা জীবনকে নির্মমভাবে ছিঁড়ে ফেলে। ২০০৯ সালের এক হাড়-কাঁপানো জানুয়ারির সকালে, নিউইয়র্কের লা গার্ডিয়া বিমানবন্দর থেকে উড়েছিল ইউএস এয়ারওয়েজ ফ্লাইট ১৫৪৯। গন্তব্য ছিল নর্থ ক্যারোলাইনা। কিন্তু আকাশে ওড়ার ঠিক ৯০ সেকেন্ডের মধ্যে, বিমানের দুটি ইঞ্জিনই বিকল হয়ে যায় পাখির ঝাঁকে ধাক্কা লেগে। 

বিমানটি তখন ছিল শহরের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া অবস্থায়। নিচে জঙ্গল, মানুষে ভরা রাস্তা, হাজারো গাড়ি, অসংখ্য ভবন। মৃত্যু তখন মাত্র কয়েক সেকেন্ড দূরে। এরপর যা ঘটলো, তা ইতিহাসে জায়গা করে নিলো “Miracle on the Hudson” নামে। পাইলট ক্যাপ্টেন চেসলি ‌‘সুলি’ সুলেনবার্গার জানালেন, এটা ছিল কোনো অলৌকিকতা নয়। বরং এটি ছিল শৃঙ্খলা, ট্রেনিং, প্রস্তুতি আর পারস্পরিক বিশ্বাসের বাস্তব প্রতিফলন।

তিনি বলেন, আমি আর কো-পাইলট স্কাইলস জানতাম। কে কী করবে। চেকলিস্ট ছিল, নির্দেশনা ছিল, প্রতিটি সিদ্ধান্ত আমরা ঠান্ডা মাথায় নিয়েছিলাম। ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্টরা তাদের ভূমিকা পালন করেছেন নিখুঁতভাবে। ফেরি চালকেরা এক মুহূর্ত দেরি করেনি। রেসকিউ দল, হাসপাতাল, এমনকি শহরের ফায়ারবোট পর্যন্ত ছিল প্রস্তুত।

১৫৫ জন যাত্রী। একটি বিকল বিমান। তবু কেউ মারা যায়নি। এই ঘটনাটি যেন বিশ্বকে দেখিয়ে দিলো—দুর্যোগ কোনো দৈব ঘটনা নয়। মানুষের প্রস্তুতি, সহযোগিতা আর পেশাদারত্বের সম্মিলিত ফসল হতে পারে বাঁচার এক অপার গল্প। 

আরেকটি গল্প: ২০২৫ সালের জুলাই মাস। সকালটা ছিল অন্য দশটা দিনের মতোই। ঢাকা শহরের উত্তরা এলাকায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিশুরা ক্লাসে বসে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছিল। কেউ অঙ্ক কষছিল, কেউ কবিতা মুখস্থ করছিল, কেউ হয়ত স্বপ্ন আঁকছিল চোখে।

কিন্তু কিছুক্ষণ পর, আকাশ ফেটে নামে দুঃস্বপ্ন। একটি যুদ্ধ বিমান নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ভেঙে পড়ে স্কুল ভবনের ছাদে। মুহূর্তেই ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় শিশুর শরীর, বইয়ের ব্যাগ রক্তে ভিজে ওঠে, ধুলোয় মিশে যায় স্বপ্ন। অনেকেই ঘটনাস্থলেই নিহত হন। অনেকে গুরুতর আহত অবস্থায় ছটফট করতে থাকেন। শিক্ষকদের কেউ কেউ বুক দিয়ে ঢেকে রাখেন ছাত্রদের—নিজেরা হয়ে ওঠেন রক্তাক্ত।

এই দৃশ্যের পরেই শুরু হয় এক আরও ভয়াবহ ট্র্যাজেডি—উদ্ধার ও চিকিৎসার নামে বিশৃঙ্খলা, উদাসীনতা ও দায়হীনতা।প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, উদ্ধার কাজে ছিল না কোনো সমন্বয়। সেনাবাহিনী দেরিতে আসে, আহতদের উদ্ধারের বদলে কেউ কেউ ছবি তোলে। আহতদের কাঁধে চেপে কেউ করে ফেসবুক লাইভ। হাসপাতালে নেওয়ার পথ আটকে দাঁড়িয়ে যায় মিডিয়া আর রাজনৈতিক নেতাদের প্রটোকল। 

এরপর আসে ‘মরদেহ গুম’, ‘চিকিৎসায় গাফিলতি’, ‘রাজনৈতিক শো’-এর ভয়ংকর সব অভিযোগ। আইসিইউর বেড দখল করে নেয় দলের নেতাকর্মীরা। শিক্ষার্থীদের পরিবার হারিয়ে ফেলে চিকিৎসার আশা, নিরাপত্তার বিশ্বাস, রাষ্ট্রের প্রতি আস্থা।

দুই বিপর্যয়, দুই সমাজের আয়না:

একটা দেশে, যখন দুর্ঘটনা হয়, তখন সবাই ‘কি করতে হবে’ জানে। আরেকটা দেশে, যখন দুর্ঘটনা হয়, তখন কেউই জানে না কী করতে হবে—বা কেউই করতে চায় না।

নিউইয়র্কে ফেরি চালকেরা প্রতি মাসে করে রেসকিউ ট্রেনিং। হাসপাতালে ডাক্তার-নার্সদের রোল কল হয় নিয়মিত। শহরের প্রতিটি ইমার্জেন্সি ইউনিট জানে, কে কখন কোথায় যাবে। কেউ কারও চেয়ে বড় নয়। সিস্টেম বড়। মানুষ দায়িত্ববান। সিদ্ধান্ত আসে দ্রুত ও নিখুঁতভাবে। বাংলাদেশে সেই ছবির উলটো রং।

স্কুলে ইমার্জেন্সি সেফটি প্ল্যান নেই। বেসামরিক বিমান চলাচলে নেই কোনো ব্যাকআপ প্রটোকল। রেসকিউ টিম একে অন্যের ওপর দোষ চাপায়। কেউ দায়িত্ব নেয় না, কেউ পদত্যাগ করে না, কেউ ক্ষমা চায় না। বরং ঘটনা নিয়ে বানানো হয় গল্প, চালানো হয় কভার-আপ। এই ব্যবধান শুধু প্রযুক্তির নয়। এটি দায়িত্ববোধের ব্যবধান। এটি ব্যবস্থাপনার ব্যবধান। এটি মানসিকতার ব্যবধান।

কী শেখার ছিল?

যে প্রশ্নটি আজ আমাদের সবচেয়ে বেশি তাড়া করে—কেন? কেন আমরা প্রতিবার ব্যর্থ হই? হাডসনের ‘মিরাকল’ আমাদের শেখায়, একটি দুর্ঘটনাও মহৎ হয়ে উঠতে পারে—যদি প্রত্যেকে নিজ দায়িত্ব পালন করে। সুলি কখনো চিৎকার করেননি। স্কাইলস ভুল করেননি। ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্টরা দিকভ্রান্ত হননি। ট্রাফিক কন্ট্রোল ব্যর্থ হয়নি। রেসকিউ ফেরিগুলো সাড়া দিতে এক মিনিট দেরি করেনি।

অন্যদিকে মাইলস্টোনের ঘটনায় কেউ কোনো প্রোটোকল জানত না। অ্যাম্বুলেন্স যথাসময়ে এলো না, পুলিশ জানত না কে আগে যাবে, স্কুল জানত না কী করতে হবে, মিডিয়া জানত না কোথায় থামতে হয়।

শিশুদের মুখ মনে পড়ে?

সেই শিশুগুলো যারা হয়ত ভেবেছিল, ‘আজকের ক্লাসে স্যার হেনরী’র কবিতা পড়াবেন’। সেই মেয়েটা, যে হয়ত দুপুরে টিফিনে মা’র দেওয়া কেক খাবে বলে অপেক্ষা করছিল। সেই ছেলেটা, যে ফাইনাল পরীক্ষার জন্য নতুন কলম কিনেছিল। তাদের কেউ নেই আর। আর যারা আছে তাদের চোখে রয়েছে ভয়, মনে রয়েছে ট্রমা, হৃদয়ে রয়েছে প্রশ্ন।

এখন কী করণীয়?

আমরা কি শুধু শোক করেই থেমে থাকব? না কি এবার প্রস্তুতি নিতে শিখব? এবার কি সময় হয়নি স্কুলে নিয়মিত সেফটি ড্রিল চালু করার? হাসপাতালগুলোর জন্য ইমার্জেন্সি গাইডলাইন তৈরি করার? বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ এলাকায় স্কুল-কলেজের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলার? আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, রাষ্ট্রের প্রতিটি সংস্থাকে জবাবদিহিতার কাঠামোর মধ্যে আনার? শোককে শক্তিতে রূপ দিতে হবে।

পাইলট সুলি বলেছিলেন, ‘হাডসনের মিরাকল কোনো অলৌকিকতা ছিল না। এটা ছিল দায়িত্বশীলতা, প্রস্তুতি আর বিশ্বাসের ফলাফল।’  আমাদের মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি তার উলটো ছবি প্রস্তুতিহীনতা, অব্যবস্থা আর উদাসীনতার ভয়াবহ ফল। এই ভয়াবহ দিন যেন আমাদের ঘুম ভাঙিয়ে দেয়।

এই শিশুদের রক্ত যেন আমাদের দায়বদ্ধ করে তোলে। এই শোক যেন আমাদের শিখিয়ে দেয়। অলৌকিকতা চেয়ে নয়, দায়িত্ব নিয়েই জীবন রক্ষা করা যায়। আমরা নিহত শিক্ষার্থীদের আত্মার শান্তি কামনা করি। আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করি। আর রাষ্ট্রের কাছে জোরালো আহ্বান জানাই এই ঘটনাকে ‘আরেকটি শোকের দিন’ হিসেবে না রেখে, একটি পরিবর্তনের দিন হিসেবে চিহ্নিত করুন।

লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক

মন্তব্য করুন