রবিবার, ২৯ জুন ২০২৫, ১৫ আষাঢ় ১৪৩২

লংগদুর থেকে আজহার, এক শিক্ষার্থীর সংগ্রামী জীবন

আফছার হোসাইন, মিশর থেকে
  ২৪ জুন ২০২৫, ২৩:৪০
ছবি-সংগৃহীত

রাঙামাটির লংগদুর সবুজ পাহাড় আর মাইনী নদীর বুক চিরে যে সূর্য প্রতিদিন উদিত হয়, সেই আলো আজ পৌঁছে গেছে সুদূর মিশরের ঐতিহাসিক বিদ্যাপীঠ আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায়। আর এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে লংগদুর গাঁথাছড়া গ্রামের এক সংগ্রামী তরুণ, যিনি সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে পৌঁছেছেন জ্ঞানের অন্যতম শিখরে। 

সম্প্রতি মিশরের রাজধানী কায়রোতে আশ্রয় নেওয়া ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের মাঝে বাংলাদেশ থেকে পাঠানো নগদ অর্থ ও উপহার বিতরনি এক অনুষ্ঠানে কথা হয় রিদওয়ান নামের এক তরুণের সাথে। 

সে জানায়, ২০০৪ সালে রাঙামাটির লংগদু উপজেলার গাঁথাছড়া গ্রামে, এক ধর্মভীরু মুসলিম পরিবারে তার জন্ম। বাবার নাম শাহ ফরিদ আলী, মাত্র ৮ মাস বয়সে বাবার ছায়া হারিয়ে শৈশব কেটেছে মায়ের অশেষ ত্যাগ ও ভালোবাসার মাঝে। বাবা না থাকলেও বড় ভাইদের সহযোগিতা, মায়ের সাহস আর নিজের অদম্য সংকল্প ছিল তাঁর জীবনের চালিকাশক্তি।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে পড়া-লেখা করেছেন মাইনী নদীর তীরে অবস্থিত গাঁথাছড়া বায়তুশ শরফ আদর্শ দাখিল মাদ্রাসা-তে। এখান থেকে তিনি ২০২০ সালে দাখিল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর উচ্চতর শিক্ষার জন্য পাড়ি জমান চট্টগ্রামে, ভর্তি হন ঐতিহ্যবাহী বায়তুশ শরফ কামিল মাদ্রাসায়, যেখানে থেকে ২০২২ সালে আলিম সম্পন্ন করেন।

সেখানেই থেমে থাকেনি তাঁর স্বপ্নের পথচলা। নিজের মেধা ও অধ্যবসায়ের বলে সুযোগ পান বিশ্বখ্যাত আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে বর্তমানে তিনি ইসলামিক থিয়োলজি বিভাগে স্নাতক পর্যায়ে অধ্যয়নরত।

শুধু পড়াশোনা নয়, রিদওয়ানের জীবন আলোকিত করেছে বহুস্তরীয় প্রতিভায়—তিনি একজন কবি, ইসলামিক গজলশিল্পী, বক্তা, বিতার্কিক এবং স্কাউট লিডার। তাঁর রচিত গজল দেশের স্বনামধন্য শিল্পীদের কণ্ঠে পেয়েছে জনপ্রিয়তা। ইসলামি সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রসারে তিনি গঠন করেন “আবাবিল শিল্পীগোষ্ঠী” নামে একটি প্ল্যাটফর্ম, যা লংগদু অঞ্চলের তরুণদের মাঝে সৃষ্টি করেছে নতুন উদ্দীপনা।

শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই নেতৃত্বগুণ ছিল প্রকট—তিনি ক্লাস ক্যাপ্টেন হিসেবে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছেন, অংশ নিয়েছেন বিভিন্ন বিতর্ক, বক্তৃতা, কবিতা আবৃত্তি, খেলাধুলা ও প্রতিযোগিতায়। এতে করে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে নিজ প্রতিষ্ঠান এবং লংগদুর সম্মান অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে।

তাঁর সাফল্য নিছক ব্যক্তিগত নয়—এটি একটি জনপদের, একটি অঞ্চলের, একটি জাতিগত আত্মপরিচয়েরও বিজয়। যেখানে অনেকেই উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখতে সাহস পান না, সেখানে রিদওয়ান হয়ে উঠেছেন এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, একটি জীবন্ত অনুপ্রেরণা।

এস এম রিদওয়ান নিজেকে শুধুই একজন আলেম বা শিক্ষার্থী হিসেবে নয়, বরং মানুষের কল্যাণে নিবেদিত একজন সামাজিক দিশারি হিসেবে গড়ে তুলতে চান। তাঁর ভাষায়, "আমার এই পথচলার পেছনে মায়ের ভালোবাসা, শিক্ষকদের দোয়া, এবং আল্লাহর অশেষ রহমত। আমি বিশ্বাস করি, চেষ্টা ও নিষ্ঠা থাকলে পৃথিবীর যেকোনো মঞ্চেই নিজের জায়গা করে নেওয়া সম্ভব।"

মন্তব্য করুন