নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ঘিরে সম্প্রতি একটি বিতর্ক বাংলাদেশকে এক নতুন কূটনৈতিক ঝড়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমারের সঙ্গে বৈঠকের মিথ্যা দাবি ঘিরে শুরু হওয়া এই বিতর্ক এখন ছড়িয়ে পড়েছে আন্তর্জাতিক মহলে, যা ভবিষ্যতে বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিতে দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়া ফেলতে পারে।
২০২৫ সালের জুনের শুরুতে বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয় যে, ড. ইউনূস ব্রিটেনের নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের আমন্ত্রণে ডাউনিং স্ট্রিটে বৈঠক করতে যাচ্ছেন। চ্যানেল আই, যমুনা টিভি, দেশ টিভিসহ একাধিক বড় সংবাদমাধ্যম গুরুত্বের সঙ্গে খবরটি প্রচার করে। ইউনূস ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র এ তথ্য জানায় বলে দাবি করা হয়।
তবে ১২ জুন বিবিসিকে দেওয়া এক বিবৃতিতে ১০ ডাউনিং স্ট্রিট সরাসরি এ দাবি অস্বীকার করে। প্রধানমন্ত্রীর মুখপাত্র জানান, “ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকের কোনো নির্ধারিত সময় নেই, এমনকি আমন্ত্রণপত্রও পাঠানো হয়নি।” পরে ড. ইউনূসের জনসংযোগ টিম দাবি করে, বৈঠকটি “স্থগিত” করা হয়েছে, কারণ স্টারমার তখন “বিদেশ সফরে” ছিলেন — কিন্তু এটি আরও বিপরীত তথ্যের জন্ম দেয়।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর অফিসিয়াল ক্যালেন্ডার ও দ্য গার্ডিয়ানসহ প্রধান সংবাদমাধ্যম নিশ্চিত করে জানায়, স্টারমার লন্ডনেই অবস্থান করছিলেন; কানাডা সফরের কোনো তথ্য নেই। এই বিভ্রান্তি শুধু ব্রিটেনেই নয়, বরং আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহলেও অস্বস্তির সৃষ্টি করেছে। ১৪ জুন লন্ডনের চ্যাথাম হাউজে অনুষ্ঠিত এক আলোচনায় যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মন্তব্য করেন, “এ ধরনের ভুল তথ্য আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন করে এবং আস্থার সংকট তৈরি করে।”
যুক্তরাষ্ট্রেও বিষয়টি গুরুত্ব পায়। স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার ১৫ জুন জানান, “বাংলাদেশে গণতন্ত্র, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইস্যুতে USAID-এর সহায়তা পুনর্মূল্যায়নের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।” বিষয়টি নিয়ে বিএনপি নেতা তারেক রহমানের নামও আলোচনায় এসেছে, যিনি বর্তমানে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম যেমন The Economist ও Politico EU–তে তাঁর ও ড. ইউনূসের ঘনিষ্ঠতা নিয়ে বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়েছে, যা বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. হেনরি ম্যাকডোনাল্ড Chatham House–এর এক নীতিপত্রে লেখেন, “বাংলাদেশ যখন অর্থনৈতিক সংকটে রয়েছে, তখন এ ধরনের বিভ্রান্তিকর তথ্য দেশের ভাবমূর্তি ও বিদেশি বিনিয়োগের জন্য গুরুতর হুমকি।” ড. ইউনূসের একটি বিতর্কিত দাবি থেকে শুরু হলেও, ঘটনাটি এখন বাংলাদেশের সামগ্রিক কূটনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বমঞ্চে আস্থার প্রশ্নে রূপ নিয়েছে। বিদেশি সহায়তা, বিনিয়োগ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক—সবকিছুতেই এর প্রভাব পড়তে পারে।
বর্তমানে এ বিতর্কের আনুষ্ঠানিক নিষ্পত্তি হয়নি। তবে কূটনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশ সরকার ও রাজনৈতিক মহলের উচিত দ্রুত স্বচ্ছতা ও দায়িত্বশীলতার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আস্থার সংকট মোকাবিলা করা, না হলে ভবিষ্যতের জন্য মূল্য চুকাতে হতে পারে। সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ: চ্যানেল আই, বিবিসি, দ্য গার্ডিয়ান, চ্যাথাম হাউজ, ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্ট, দ্য ইকোনমিস্ট।
মন্তব্য করুন