মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫, ২৪ আষাঢ় ১৪৩২

মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫, ২৪ আষাঢ় ১৪৩২

লালন সাঁইয়ের ১৩৪তম তিরোধান দিবসে বসেছে সাধুর হাট

নিজস্ব প্রতিবেদক
  ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ১২:৪৯

আধ্যাত্মিক সাধক ফকির লালন সাঁইয়ের ১৩৪তম তিরোধান দিবস উপলক্ষে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়া আখড়াবাড়িতে সকাল থেকে শুরু হয়েছে তিনদিন ব্যাপী লালন স্মরণোৎসব। এবারের প্রতিপাদ্য ফকির লালন শাহের অমর বাণী ‘সময় গেলে সাধন হবে না।’
বৃহস্পতিবার (১৭ অক্টোবর) আনুষ্ঠানিক ভাবে এর উদ্বোধন করা হবে সন্ধ্যায়। ১৭ অক্টোবর থেকে চলবে ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত।

এ উপলক্ষে সাধুর হাট বসছে ছেঁউড়িয়ায়, লালনের আখড়াবাড়িতে। এ সাধুসঙ্গে সাধু-বাউল-ফকিররা যোগ দিয়েছেন। আর মিলন মেলায় যুক্ত হয়েছে পর্যটক দর্শনার্থীরা। সকাল থেকে শুরু হয়েছে গুরু-শিষ্যের সাধন-ভজন ও ভক্তি-শ্রদ্ধা নিবেদন। ‘অসাম্প্রদায়িক, মানবতাবাদী, অহিংস’ লালন দর্শনের গানে মুখর এখন ছেউড়িয়া এলাকা। আখড়াবাড়ির বাইরে বসছে তিনদিনের লালন মেলা।

লালন মেলার এক সপ্তাহ আগে থেকেই হাজারো ভক্ত-অনুসারীরা দূর-দূরান্ত থেকে আসতে শুরু করেছেন। লালন মেলা উপলক্ষে আখড়াবাড়িতে হাজারো ভক্ত-অনুসারীদের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে।

দোল পূর্ণিমার রাতে আনুষ্ঠানিভাবে বাউল ফকির লালন শাহের সমাধি প্রাঙ্গণে এ স্মরণোৎসব উদ্বোধন করা হবে আজ সন্ধ্যায়। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে দেশি ও বিদেশি লাখো বাউল ভক্তের উপস্থিতি লালন আখড়াবাড়িতে।

উৎসবকে কেন্দ্র করে লালন আখড়াবাড়িতে এরই মধ্যেই সব প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। মাজারকে সাজানো হয়েছে বর্ণিল সাজে। এখানে রয়েছে সিসি ক্যামেরাসহ রয়েছে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এই তিনদিন কালী নদীর পাড়ে উন্মুক্ত মঞ্চে লালনের জীবন দর্শন নিয়ে হবে আলোচনা ও লালন সংঙ্গীত।

কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়া লালন আখড়াবাড়িতে দুটি অনুষ্ঠানে সাধু ভক্ত এবং অনুসারীদের সমাগম ঘটে। এর একটি পহেলা কার্তিক লালন তিরোধান দিবস আর অপরটি ফাল্গুন মাসের দোল পূর্ণিমার দিন দোলোৎসব। এই অনুষ্ঠান দুটি ঘিরে আঁখড়াবাড়িতে আয়োজন করা হয় সাধুসঙ্গ। কোনো সাধক ফকিরকে আমন্ত্রণ জানানোর প্রয়োজন হয় না অনুষ্ঠানের জন্য। 

উৎসব দুটির কয়েকদিন আগেই দেশ-বিদেশ থেকে সাধু ভক্তরা চলে আসেন উৎসব অঙ্গনে। এবারো তার ব্যাত্যায় ঘটেনি ছুটে আসছেন সাধু ভক্তরা ও অনুসারীরা। এই সাধুসঙ্গ ঘিরে সাঁইজির অনুসারিদের মনে বইছে স্বর্গীয় আনন্দ।

বাউল সম্রাটের তিরোধান দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এই স্মরোণোৎসব কেন্দ্রকে একদিকে চলছে শিল্পীদের গান পরিবেশনের প্রস্তুতি। অপরদিকে সাধুগুরুরা ব্যস্ত সময় পার করছে তাদের প্রাণ পুরুষকে স্মরণ করতে। 

আর ফকির লালন সাঁইজি ও তার শিষ্যরা চিরনিদ্রায় শায়িত সেখানে প্রথা অনুযায়ী সেখানে ভক্তি শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন ভক্ত-অনুসারীরা। গুরু-শিষ্যের মিলন হলে দেখা মিলছে হাতে হাত রাখার অপূর্ব দৃশ্য।

প্রবীণ সাধু নহির শাহ, হালের হৃদয় শাহসহ অনেক সাধু-ফকিরই এরইমধ্যে আখড়াবাড়ির ভেতরে অডিটোরিয়ামের নিচে আসন পেতে বসেছেন। 

নহির শাহ বলেন, প্রায় দুইশ বছর আগে ফকির লালন সাঁই এই ছেঁউড়িয়ায় দোল পূর্ণিমার তীথিতে সাধুসঙ্গ করতেন। গানে গানে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ছড়িয়ে দিতেন। সেই রেওয়াজ মোতাবেক অধিবাস, বাল্যসেবা ও পূর্ণসেবার মধ্য দিয়ে এখনো এই দোল উৎসব হয়। পাশাপাশি ১২৯৭ বঙ্গাব্দের পহেলা কার্তিক লালন সাঁইজির দেহত্যাগের পর থেকে যুক্ত হয়েছে আরেকটি অনুষ্ঠান। দৌল উৎসবের আদলে ১৩৪ বছর ধরে তিরোধান উৎসবেও সাধু-বাউলরা লালনকে স্মরণ করছেন।

ফকির হৃদয় শাহ বলেন, এই পূণ্যধামে যতো আয়োজন আছে তার মধ্যে সাধুসঙ্গই বড় বিষয়। সূচনা হবে পয়লা কার্তিক সন্ধ্যার গুরুকাজ দিয়ে। এর অষ্টপ্রহর পর পূর্ণ সেবা দিয়ে এটি শেষ হবে। এই সময়টিতে লালনের বাণী, তার আকুতি, স্রষ্টার সঙ্গে মেলবন্ধন ও সাধুর আবেশ নিয়ে যে সঙ্গটি হয় এটি বরাবরই দেখতে একই রকম। কিন্তু এরমধ্যেও ভিন্নতা তৈরি হয় কতটুকু শিখতে পারলাম এবং ধরে রাখতে পারলাম তার মধ্য দিয়ে।

লালন মেলায় আসা দর্শনার্থীরা বলেন, লালন মেলায় উপলক্ষে আখড়াবাড়িতে দূর-দূরান্ত থেকে ভক্ত অনুসারীরা এসেছেন। এখানে এসে খুবই ভালো লাগছে। লালন ভক্ত ও অনুসারীদের আস্তানাগুলো দেখতে খুব সুন্দর লাগছে। তাদের গাওয়া গান শুনতে ভালো লাগে। জায়গায় জায়গায় তারা গান গাচ্ছেন। লালন সাঁইজির গানে ও বাণীতে এই এলাকার মুখরিত হয়ে উঠেছে।

লালন অ্যাকাডেমির কয়েকজন সদস্য ও স্থানীয়রা বলেন, লালন ফকির দীর্ঘ সময় ধরে তার নিজস্ব আত্মদর্শনের আলোকে ভক্ত আশেকান ও শিষ্যদের নিয়ে যেসব উৎসবমুখর কর্মকাণ্ড করতেন তারই ধারাবাহিকতায় পহেলা কার্তিক সাঁইজির তিরোধান দিবস পালন করতে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভক্তশিষ্য-অনুসারীরা ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়িতে মিলিত হন।

ভাবনগর শিল্প ও সাহিত্য চর্চা কেন্দ্রের সভাপতি ওস্তাদ হবিবর রহমান বিশু বলেন, ফকির লালন শাহের বাউল মতকে একটি স্বতন্ত্র ধর্ম বলে মনে করেন বাউল ভক্তরা। বাউলদের এই ধর্মমতের আলোচনার জায়গা সাধুসঙ্গ। সাধুসঙ্গে বাউলরা মিলিত হন। গুরুশিষ্যের মধ্যে চোখে চোখে ভাবের আদান প্রদান আর তত্ত্বজ্ঞানের আলোচনায় মেতে উঠেন তারা।

লালন একাডেমির সাবেক সাধারণ সম্পাদক তাইজাল আলী খান বলেন, ফকির লালন শাহ জীবনদর্শায় দোল পূর্ণিমার তীথিতে সাধুসঙ্গ করতেন তারই ধারাবাহিকতায় শত শত বছর ধরে সাধু সঙ্গ হয়ে আসছে।

সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় লালন একাডেমির আয়াজনে এ উৎসব হচ্ছে। এবারের প্রতিপাদ্য ফকির লালন শাহের অমর বাণী ‘সময় গেলে সাধন হবে না।’

ভক্তবৃন্দসহ জনসাধারণের নিরাপত্তা এবং অনুষ্ঠানটি শান্তিপূর্ণ ও নির্বিঘ্ন করার জন্য জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন যৌথ ভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। অনুষ্ঠানের নিরাপত্তার দায়িত্ব পেয়েছে যৌথভাবে পুলিশ এবং র‌্যাব-১২।

কুষ্টিয়ার ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক ও লালন অ্যাকাডেমির অ্যাডহক কমিটির সভাপতি শারমিন আখতার বলেন, বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহের ১৩৪তম তিরোধান দিবস উপলক্ষে তিনদিন ব্যাপী লালন মেলার আয়োজন করা হয়েছে। লালন তিরোধান দিবস ও গ্রামীণ মেলাকে প্রাণবন্ত করার জন্য সবরকম ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। 

আমাদের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা সেখানে দায়িত্ব পালন করবেন নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য। প্রতিদিনই সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে আলোচনা সভা শুরু হবে, আলোচনা শেষে শুরু হবে লালন সঙ্গীত। মাজার প্রাঙ্গণ ও তার আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা হয়েছে। যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে পর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাঠ পর্যায় কাজ করছে।

কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার (এসপি) মো. মিজানুর রহমান বলেন, অনুষ্ঠান ঘিরে মাজার প্রাঙ্গণ ও তার আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। পুরো মাজার এলাকা সিসি ক্যামেরার আওতায় থাকছে। পুলিশ, র‌্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য রীতিমতো দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছেন তারা।

মন্তব্য করুন