শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের দল ঘোষণা হয়ে গেছে। বরাবরের মতো এবারও দলে জায়গা করে নিয়েছেন দলের আশেপাশে থাকা ক্রিকেটাররাই। জাতীয় দল থেকে অনেক দিন বাইরে, এমন ক্রিকেটাররা ঘরোয়া ক্রিকেট, এ দলের হয়ে দারুণ পারফর্ম করেও স্কোয়াডে জায়গা করে নিতে পারেননি। মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত ‘সেই পারফর্ম করেও স্কোয়াডে জায়গা না পাওয়া’দেরই একজন।
বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে সবশেষ খেলেছেন সেই ২০২২ সালে। সে বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খেলার পর থেকে জাতীয় দলে ব্রাত্য হয়ে পড়েন তিনি। ওয়ানডে ফরম্যাটে শেষ ম্যাচটা তিনি খেলেছেন সে বছর ৫ আগস্ট জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। এরপর থেকে আর জাতীয় দলের পথটা মাড়ানো হয়নি তার।
দল থেকে বাদ পড়লে দলে ফেরার পথটা দেখায় ঘরোয়া ক্রিকেটের পারফর্ম্যান্স। দুনিয়ার আর সব দেশে বাস্তবতাটা এমনই। তবে অবস্থাদৃষ্টে বলা যায়, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পরিস্থিতিটা ভিন্ন। এখানে ঘরোয়া ক্রিকেটে দারুণ পারফর্ম করেও জাতীয় দলের টিকিট মেলে না আদৌ।
মোসাদ্দেক এবার ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে খেলেছেন ১৬ ম্যাচে। চ্যাম্পিয়ন আবাহনীর সবচেয়ে বড় পারফর্মার তিনিই ছিলেন। ১৬ ইনিংসে তিনি ব্যাট করেছেন, তুলেছেন ৪৮৭ রান, গড় ৪৮ ছুঁইছুঁই, স্ট্রাইক রেটটাও বেশ স্বাস্থ্যকর, ১০৬.৩৩। মোহামেডানের মতো দলের বিপক্ষে লিগের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে তিনি খেলেছেন অপরাজিত ৭৮ রানের ইনিংস, এছাড়াও তিনি এবারের মৌসুমে দলের প্রয়োজনের মুহূর্তে হতাশ করেননি। তবে মোসাদ্দেক তার চেয়েও বেশি সফল ছিলেন বল হাতে। ৩০ উইকেট নিয়েছেন সব মিলিয়ে। টুর্নামেন্টের সেরা বোলারও তিনিই।
ঘরোয়া ক্রিকেটে দারুণ পারফর্ম করে সেটা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে টেনে আনতে না পারার অপবাদ অনেকের ক্ষেত্রেই ওঠে। মোসাদ্দেক এক্ষেত্রেও উতরে যাবেন পাসমার্ক পেয়ে। এ দলের সবশেষ সিরিজে তিনি দুই ম্যাচে বল করে তুলে নিয়েছিলেন ৫ উইকেট।
সব মিলিয়ে শেষ ১৯ ম্যাচে তিনি রান করেছেন ৫০৪ আর বল হাতে তুলে নিয়েছেন ৩৫ উইকেট। এমন একজন জাতীয় দলের আলোচনাতেও নেই। কেন? দলে যে একই প্রোফাইলের আরও এক ক্রিকেটার রয়েছেন! সে ক্রিকেটার আবার যেই সেই কেউ নন, তিনি খোদ অধিনায়ক মেহেদী হাসান মিরাজ।
প্রধান নির্বাচক গাজী আশরাফ হোসেন লিপুর কথাটা শুনুন একবার। তিনি বলেছেন, ‘আমার মনে হয় না এই মুহূর্তে জাতীয় দলে মোসাদ্দেক হোসেনের জন্য কোনো জায়গা খালি আছে। পরিষ্কারভাবে বলতে চাচ্ছি, যতক্ষণ মেহেদী হাসান মিরাজ আছে, ততক্ষণ মোসাদ্দেকের কোনো সুযোগ নেই।’
ঘরোয়া ক্রিকেট আর ‘এ’ দলের ম্যাচে দারুণ পারফর্ম করেও স্কোয়াডে জায়গা না পাওয়া ক্রিকেটার আরও আছেন। ১৯ ম্যাচে ৬৬৬ রান করে নুরুল হাসান সোহানও ব্রাত্যই রয়ে গেছেন। এমন পরিস্থিতিতে আক্ষেপ করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না কারও। সোহানও তাই করলেন। বললেন, ‘অবশ্যই আক্ষেপটা থাকবে। জাতীয় দলের খেলা গর্বের বিষয়। জাতীয় দলের হয়ে খেলতে চাই। যখন জাতীয় দলের হয়ে খেলার স্বপ্ন থাকবে না, তখন হয়তো ক্রিকেটটা খেলব না।’
সোহানের আশাটা অবশ্য শেষ হয়নি। নির্বাচক লিপু তার প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘সোহানের ব্যাপারটা হচ্ছে, তিনি আমাদের বিবেচনায় আছেন। কিন্তু একই দলে আমরা একাধিক উইকেটকিপার নিতে পারি না এই পজিশনে।’
সোহানের মতো সুপ্রসন্ন নয় মোসাদ্দেকের ভাগ্যটা। নির্বাচক লিপু যেমন সোহানের জন্য বলেছেন, ‘বিবেচনায় আছেন’, সেই লিপুই মোসাদ্দেকের বেলায় বললেন, ‘মিরাজ যতদিন আছে, ততদিন সুযোগ নেই মোসাদ্দেকের।’
মিরাজ বর্তমানে ওয়ানডে দলের অধিনায়ক। তিনি অন্তত ২০২৬ সালে তার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত দল থেকে বাদ পড়ছেন না, এটা নিশ্চিত। ফলে মোসাদ্দেকও যে ২০২৬ সালের আগ পর্যন্ত দলে আসার বিবেচনাতেও আসছেন না, এটা পরিষ্কার হয়ে যায়।
মোসাদ্দেক আর মিরাজ ডানহাতি অফ স্পিনার, মিডল অর্ডারে ব্যাট করেন। দুজনের প্রোফাইল একই হয়ে যাওয়ার ফলেই যে মোসাদ্দেকের দলে জায়গা মিলছে না, সে বিষয়টা পরিষ্কার।
তবে এই যুক্তি ধোপে টেকে না অতীতের দিকে তাকালে। বাংলাদেশ দলে আগেও একই প্রোফাইলের দুই কিংবা তার চেয়েও বেশি স্পিনার ছিলেন। মোসাদ্দেক তার পুরো ক্যারিয়ারেই বহু ম্যাচে মিরাজের সঙ্গে খেলেছেন। এমনকি সে ম্যাচের একাদশে নাসির, মাহমুদউল্লাহদের মতো ডানহাতি অফ স্পিনার, ডানহাতি ব্যাটার প্রোফাইলের খেলোয়াড়রাও ছিলেন, সবাই যার যার মতো পারফর্মও করেছেন। অথচ এখন এই যুক্তি তার পথ আগলে দাঁড়াচ্ছে মোসাদ্দেকের।
৩ বছর ধরে জাতীয় দল থেকে ব্রাত্য অলরাউন্ডার তাই অন্ধকার টানেলের শেষের আলোর দেখা পাচ্ছেন না। কবে পাবেন, তাও অনিশ্চিত। সোহান যেমন বললেন, ‘স্বপ্নটা না থাকলে ক্রিকেটটাই ছেড়ে দিতাম’, মোসাদ্দেকের সামনে তো সে বাস্তবতাটাই হাজির!
এমন পারফর্ম করেও দলে জায়গা মিলছে না। মুখের ওপর বলে দেওয়া হলো, ‘জায়গা নেই’! মোসাদ্দেক তাহলে এবার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটটাকে বিদায় বলে দিলেই পারেন!
মন্তব্য করুন