ইসরাইলের সঙ্গে ১২ দিন যুদ্ধের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি করেছে ইরান। এরপর ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির অনুপস্থিতি নিয়ে দেশটির জনগণের মধ্যে সৃষ্ট উদ্বেগ ও নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
বুধবার (২৫ জুন) এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসের ব্যুরো চিফ ফারনাজ ফসিহি।
দেশজুড়ে মানুষ যখন উৎকণ্ঠায়, তখন ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের এক উপস্থাপক সরাসরি প্রশ্ন তুলেন খামেনি এখন কোথায়? এ প্রশ্ন এখন রাজনৈতিক অঙ্গন আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘মানুষ সর্বোচ্চ নেতাকে নিয়ে খুবই চিন্তিত’, গত মঙ্গলবার উপস্থাপক আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির দপ্তরের এক কর্মকর্তাকে এ কথা বলেন। তিনি জানতে চান, ‘তার কী অবস্থা, বলতে পারেন?’
উপস্থাপক ওই কর্মকর্তাকে জানান, দর্শকদের কাছ থেকে এই একই প্রশ্নে ভরে গেছে বার্তাকক্ষ। তবে খামেনির আর্কাইভ দপ্তরের কর্মকর্তা মেহদি ফাজায়েলি সরাসরি কোনো উত্তর দেননি।
উলটো ফাজায়েলি বলেন, ‘আমরাও অনেক জায়গা থেকে এমন উদ্বেগের খবর পাচ্ছি। ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের ভয়াবহ বোমা হামলার পর আয়াতুল্লাহর নিরাপত্তা নিয়ে বহুজন উদ্বিগ্ন।’
‘আমাদের সবাইকে তার জন্য দোয়া করতে হবে,’ বলেন ফাজায়েলি।
এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘সর্বোচ্চ নেতাকে রক্ষা করা যাদের দায়িত্ব, তারা কাজ ভালোভাবেই করছেন। আল্লাহ চাইলে, আমাদের জনগণ তাদের নেতাকে সঙ্গে নিয়েই বিজয় উদযাপন করতে পারবেন।’
প্রায় এক সপ্তাহ ধরেই জনসমক্ষে অনুপস্থিত খামেনি। কোনো ভাষণ বা বার্তাও দেননি। অথচ দেশ তখন গভীর সংকটে।
খামেনির এই নীরবতা জন্ম দিচ্ছে নানা প্রশ্ন ও জল্পনার। সাম্প্রতিক বড় সিদ্ধান্তগুলোতে তার ভূমিকা কতটুকু? তার কাছে পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়েছে কি? তিনি এখনো দেশ পরিচালনায় সক্রিয়? তিনি অসুস্থ, আহত কিংবা আদৌ বেঁচে আছেন কি?
এ সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়, জবাবে (সোমবার) ইরান কাতারে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিতে (মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ঘাঁটি) ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। এরপরই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় ইরান ও ইসরাইল এক যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছায়, যা কার্যকর হয় মঙ্গলবার সকাল থেকে।
এই পুরো সময়ে খামেনি ছিলেন অনুপস্থিত। সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, তিনি এক সুরক্ষিত বাংকারে আছেন এবং হত্যাচেষ্টার আশঙ্কায় সব ধরনের ইলেকট্রনিক যোগাযোগ এড়িয়ে চলছেন।
‘খানমান’ নামের একটি দৈনিক পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মোহসেন খালিফেহ বলেন, ‘খামেনির কয়েক দিনের এ অনুপস্থিতি আমাদের, যারা তাকে ভালোবাসি, গভীর উদ্বেগে ফেলেছে।’ দুই সপ্তাহ আগেও যে আশঙ্কা অকল্পনীয় ছিল, তা এখন স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘যদি তিনি (খামেনি) মারা যান, তার জানাজার মিছিল হবে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ও গৌরবময়।’
সর্বোচ্চ নেতাকে রক্ষা করা যাদের দায়িত্ব, তারা কাজ ভালোভাবেই করছেন। আল্লাহ চাইলে, আমাদের জনগণ তাদের নেতাকে সঙ্গে নিয়েই বিজয় উদ্যাপন করতে পারবেন।
আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির দপ্তরের কর্মকর্তা মেহদি ফাজায়েলি,বলেন, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে প্রতিটি বড় সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত অনুমোদন দেন খামেনি। সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ সামরিক পদক্ষেপ, যেমন যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিতে হামলা বা ইসরাইলের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির মতো সিদ্ধান্তে তার অনুমোদন অত্যাবশ্যক।
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আহ্বানে এবং কাতারের আমিরের মধ্যস্থতায় দ্রুত সম্পাদিত হয়। তবে ইরানের ঊর্ধ্বতন সামরিক ও সরকারি কর্মকর্তারা গত কয়েক দিনে তারা খামেনির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন কিনা বা কোনোভাবে যোগাযোগ হয়েছে কিনা, সে বিষয়ে খোলাখুলি কিছু বলেননি।
এ নীরবতা জন্ম দিচ্ছে নানা প্রশ্ন ও জল্পনার—সাম্প্রতিক বড় সিদ্ধান্তগুলোতে খামেনির ভূমিকা কতটুকু? তার কাছে পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়েছে কি? তিনি এখনো দেশ পরিচালনায় সক্রিয়? তিনি অসুস্থ, আহত কিংবা আদৌ বেঁচে আছেন কি?
রাজনৈতিক বিশ্লেষক হামজা সাফাভি আয়াতুল্লাহ খামেনির শীর্ষ সামরিক উপদেষ্টা ও রেভল্যুশনারি গার্ডস কোরের জেনারেল ইয়াহিয়া সাফাভির ছেলে। হামজা জানান, ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী বিশ্বাস করে, যুদ্ধবিরতির মধ্যেও ইসরাইল খামেনিকে হত্যাচেষ্টা চালাতে পারে। তাই তার নিরাপত্তায় কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে তার যোগাযোগ প্রায় বন্ধ রয়েছে।
চ্যাথাম হাউসের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকাবিষয়ক পরিচালক সানাম ভাকিল বলেন, খামেনির অনুপস্থিতি উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা এবং এটি এই ইঙ্গিত দেয়, ইরানি নেতৃত্ব এখন অতিমাত্রায় সতর্ক ও নিরাপত্তাকেন্দ্রিক ভাবনায় চলছে। আশুরার আগে যদি খামেনিকে দেখা না যায়, তাহলে তা হবে খারাপ সংকেত। তাকে অবশ্যই জনসমক্ষে আসতে হবে।
সাফাভি বলেন, ‘দেশকে এ সংকট থেকে উত্তরণে এখন বাস্তবমুখী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের মতো নেতাদের ক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে।’
তবে সাফাভির ধারণা, খামেনি এখনো কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দূর থেকে অনুমোদন দিচ্ছেন।
তবু খামেনির অনেক সমর্থক এখনো সামাজিকমাধ্যমে বলছেন, তারা সর্বোচ্চ নেতাকে না দেখা বা তার কথা না শোনা পর্যন্ত ইসরাইলের বিরুদ্ধে বিজয়ের আনন্দ অনুভব করতে পারছেন না।
সরকারের নীতিনির্ধারণে যুক্ত চার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, খামেনির অনুপস্থিতিতে রাজনীতিক ও সামরিক নেতারা নতুন নতুন জোট গঠন করছেন এবং ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নিয়ে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচি, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের মধ্যস্থতা কিংবা ইসরাইলের ব্যাপারে অবস্থান নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করছেন।
এ মুহূর্তে দৃশ্যত যে গোষ্ঠী অপেক্ষাকৃত প্রভাবশালী, তারা সংযম ও কূটনৈতিক পথ গ্রহণের পক্ষে। এ গোষ্ঠীর নেতৃত্বে রয়েছেন প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ান। তিনি এমনকি যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানোর পরও আলোচনায় ফেরার ইঙ্গিত দিয়েছেন। তার মিত্রদের মধ্যে আছেন আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির ঘনিষ্ঠজন ও বিচার বিভাগের প্রধান গোলাম হোসেইন মোহসেনি-এজেই ও সশস্ত্র বাহিনীর নতুন প্রধান মেজর জেনারেল আবদুর রহিম মুসাভি।
ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী বিশ্বাস করে, যুদ্ধবিরতির মধ্যেও ইসরাইল খামেনিকে হত্যাচেষ্টা চালাতে পারে। তাই তার নিরাপত্তায় কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে তার যোগাযোগ প্রায় বন্ধ রয়েছে।
যুক্তরাজ্যের নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউসের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকাবিষয়ক পরিচালক সানাম ভাকিল বলেন, ‘খামেনির অনুপস্থিতি উল্লেখযোগ্য এক ঘটনা এবং এটি এই ইঙ্গিত দেয়, ইরানি নেতৃত্ব এখন অতিমাত্রায় সতর্ক ও নিরাপত্তাকেন্দ্রিক ভাবনায় চলছে।’
তিনি বলেন, ‘আসছে আশুরার (১০ মহররম) আগে যদি খামেনিকে দেখা না যায়, তাহলে তা হবে খারাপ সংকেত। তাকে অবশ্যই জনসমক্ষে আসতে হবে।’
মন্তব্য করুন