স্প্যানিশ শহর তোরে পাচেকোতে কয়েক দিন ধরে চলা অস্থিরতা পুলিশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তা সত্ত্বেও বেড়েই চলেছে অভিবাসনবিরোধী উত্তেজনা। ডানপন্থি রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলো এই বিষয়টিকে উসকে দিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
স্প্যানিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এই সংঘর্ষের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷
ঘটনার শুরু যেভাবে
৯ জুলাই তোরে পাচেকো শহরের ৬৮ বছর বয়সি এক প্রবীণ ব্যক্তির উপর হামলার জের ধরে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে৷ তিনি স্প্যানিশ মিডিয়াকে বলেন, উত্তর আফ্রিকান বংশোদ্ভূত তিন জন পুরুষ কোনো উস্কানি ছাড়াই তার উপর আক্রমণ করেছিল৷
এর প্রতিক্রিয়ায় তোরে পাচেকো টাউন হলে শুক্রবার (১১ জুলাই) নিরাপত্তাহীনতার বিরুদ্ধে একটি বিক্ষোভের আয়োজন করে রক্ষণশীল পপুলার পার্টি (পিপি)৷ অতি ডানপন্থিরা অভিবাসীবিরোধী স্লোগান দিতে শুরু করলে বিক্ষোভ আরো তীব্র হয়ে ওঠে।
এরপর থেকে বেশ কয়েক রাতে সংঘর্ষের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে৷ যদিও পুলিশের শক্তিশালী উপস্থিতির কারণে সংঘর্ষ ঠেকানো সম্ভব হয়েছে৷
অভিবাসী এবং স্থানীয়দের মধ্যে সহিংসতার সূত্রপাত উগ্র ডানপন্থি গোষ্ঠীগুলোর সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টের কারণেই হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্প্যানিশ সরকারের এক কর্মকর্তা।
কর্তৃপক্ষ আরো জানিয়েছে, সহিংসতায় জড়িত সন্দেহে মোট ১৪ জনকে আটক করা হয়েছে, তাদের মধ্যে ৬৮ বছর বয়সি ওই বৃদ্ধের উপর হামলাকারী হিসেবে অভিযুক্ত তিন ব্যক্তিও রয়েছেন। তবে, ওই তিন জন তোরে পাচেকো শহরে বসবাস করেন না বলে জানা গেছে।
গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে অতি-ডানপন্থি গোষ্ঠী ‘ডিপোর্ট দেম নাউ’-এর একজন নেতাও রয়েছেন৷ মূলত, এই সংগঠনটি অনলাইনের মাধ্যমে তোরে পাচেকো শহরের থাকা অভিবাসীদের ‘শিকার’ করার অর্থাৎ আক্রমণ করার আহ্বান জানিয়েছে৷
শক্ত অবস্থানে পুলিশ
স্পেনের রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেল আরটিভিই জানিয়েছে, মঙ্গলবার সন্ধ্যায়ও ডানপন্থি চরমপন্থি গোষ্ঠীগুলোর একটি সমাবেশে পুলিশ কঠোরভাবে বাধা দিয়েছে৷ সামবেশে একশ জনের মতো মানুষ অংশ নিয়েছিলেন।
বুধবার এল মুন্দো সংবাদপত্র জানিয়েছে, ‘‘বিক্ষোভকারীদের চেয়ে সাংবাদিকদের সংখ্যা বেশি ছিল৷’’
তোরে পাচেকোর মেয়র শহরবাসীকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন৷ একইসঙ্গে এই ঘটনার জন্য শহরটিতে বসবাসরত অভিবাসীদের দোষারোপ না করার জন্যও সতর্ক করে দিয়েছেন৷
শহরটির মোট ৪০ হাজার মানুষের বসবাস৷ তাদের প্রায় ৩০ শতাংশ বিদেশি বংশোদ্ভূত৷ অভিবাসীদের বড় একটি অংশ ওই অঞ্চলের প্রধান অর্থনীতি কৃষি খাতে কাজ করেন৷
কিন্তু এই ইস্যুটিকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের অভিবাসনবিরোধী বক্তব্যকে আরো জোরদার করছে স্প্যানিশ পার্লামেন্টের তৃতীয় বৃহত্তম শক্তি অতি-ডানপন্থি দল ভক্স পার্টি৷
অনিয়মিত অভিবাসনকে দায়ী করছে ডানপন্থিরা
ভক্স পার্টির আঞ্চলিক নেতা হোসে আংগেল আন্তেলো ‘‘অনিয়মিত অভিবাসন’’কে এই অস্থিরতার জন্য দায়ী করেছেন৷ বলেছেন, অভিবাসীরা বয়স্কদের উপর আক্রমণ করেছে এবং অভিবাসীদের কারণে নারীরা যৌন সহিংসতার শিকার হচ্ছেন৷
দলটির জাতীয় নেতা সান্তিয়াগো আবাস্কাল এই ঘটনাটিকে ‘‘অপরাধে জড়িত অভিবাসী আক্রমণ’’ বলে অভিহিত করেছেন এবং তাদের ‘‘তাৎক্ষণিকভাবে বহিষ্কারের’’ আহ্বান জানিয়েছেন৷
প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজের সমাজতান্ত্রিক দল এই বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে৷ ভক্স পার্টি ‘‘আগুনে ঘৃণা ঢালছে’’ অভিযোগ এনেছে ক্ষমতাসীন দলটি৷
ভক্স পার্টির নেতাদের বক্তব্য ঘৃণা ও বিদ্বেষপূর্ণ অপরাধ কিনা তা খতিয়ে দেখার জন্য প্রসিকিউটরেরা তদন্ত শুরু করেছেন৷
স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদের কমপ্লুতেনসি ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানী পালোমা রোমান বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, ‘‘এই ঘটনা স্পেনে অভিবাসন সমস্যা নিয়ে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার একটি স্পষ্ট উদাহরণ৷’’
ঐতিহ্যগতভাবে অভিবাসীদের দেশ হিসাবে পরিচিত স্পেনে জীবনযাত্রার মান উন্নত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের আগমন বেড়ে গেছে৷
অভিবাসনেই বড় হচ্ছে অর্থনীতি
১৯৯৮ সালে দেশটিতে ছয় লাখ ৩৭ হাজার বিদেশি ছিলেন৷ যা মোট জনসংখ্যার ১.৬ শতাংশ৷ আর বর্তমানে দেশটিতে অভিবাসীর সংখ্যা ৬৯ লাখ ৫০ হাজার৷ সংখ্যাটি দেশটির মোট জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ৷ অভিবাসীদের মধ্যে অন্তত নয় লাখ ২০ হাজার মরোক্কোর নাগরিক৷
স্পেনের বামপন্থি সরকার বলছে, অভিবাসনের মধ্য দিয়ে জনসংখ্যা হ্রাসের প্রবণতা ঠেকানো যায় এবং শ্রমবাজারের শূন্যতা পূরণ হয়৷ তাই ২০২৭ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর তিন লাখ অনিয়মিত অভিবাসীকে নিয়মিত করতে চায় দেশটি৷
সানচেজ হলেন ইউরোপের অগ্রগণ্য দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র নেতা, যিনি অভিবাসন এবং এর অর্থনৈতিক সুবিধাগুলোর প্রতি আস্থা রেখেছেন এবং সমর্থন দিয়েছেন৷ বিপরীতে, জার্মানি, পোল্যান্ডসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি দেশ অনিয়মিত অভিবাসীদের নিয়ন্ত্রণে সীমান্তে নজরদারি চালু করেছে৷
স্পেনের জাতীয় পরিসংখ্যান ইনস্টিটিউট জানিয়েছে, অভিবাসন স্পেনের সমৃদ্ধ অর্থনীতির একটি মূল চালিকাশক্তি৷ এর মধ্য দিয়ে দেশটির অর্থনীতিতে গত বছর ৩.২ ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জন হয়েছে৷
সাম্প্রতিক ইপসোস জরিপে দেখা গেছে, মাত্র ৩৪ শতাংশ স্প্যানিশ মনে করেন, অভিবাসীর সংখ্যা সীমিত করা হলেই দেশটি ‘শক্তিশালী’ হবে৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্য দেশগুলোর তুলনায় এই সংখ্যাটি সর্বনিম্ন৷
বাড়ছে সামাজিক উত্তেজনা
অভিবাসন ইস্যুতে জনসমর্থন থাকার পরও সামাজিক উত্তেজনা বাড়ছে৷ কমপ্লুতেনসি ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানী পালোমা রোমান এই প্রবণতাটিকে অতি ডানপন্থিদের উত্থানের সঙ্গে যুক্ত করেছেন, যা অভিবাসনকে তাদের এজেন্ডার কেন্দ্রে রেখেছে৷
এই সহিংসতায় স্পেনের সাধারণ মানুষের অস্বস্তিকে পুঁজি করে সম্প্রতি বিদেশি নাগরিকদের নির্বাসনে একটি ‘অভিবাসন’ পরিকল্পনা প্রস্তাব করেছে ভক্স পার্টি৷
রোমান বলেন, ‘‘যে দেশের প্রবৃদ্ধি অভিবাসনের উপর নির্ভরশীল, সেখানে এমন অবস্থান বেশ পরস্পরবিরোধী৷’’
তিনি আরো বলেন, দুর্নীতির কেলেঙ্কারি সানচেজের সরকারকে দুর্বল করে দিয়েছে৷ ফলে, ডানপন্থিরা এই সুযোগটিকেও কাজে লাগাচ্ছেন এবং অভিবাসনকে তাদের প্রধান আলোচ্য বিষয় হিসেবে রেখেছেন৷
মন্তব্য করুন