রবিবার, ২২ জুন ২০২৫, ৮ আষাঢ় ১৪৩২
জাতীয়প্রবাস বাংলাঅপরাধবাণিজ্যরাজনীতিঅন্যান্যসারাদেশমতামতস্বাস্থ্যফিচাররাজধানীপাঠকের কথাআবহাওয়াশিল্প-সাহিত্যগণমাধ্যমকৃষি ও প্রকৃতিইসলামবৌদ্ধহিন্দুখ্রিস্টানআইন-বিচারবিবিধআপন আলোয় উদ্ভাসিতবেসরকারি চাকুরিসরকারি চাকুরি Photo Video Archive

রবিবার, ২২ জুন ২০২৫, ৮ আষাঢ় ১৪৩২

ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের নারকেলের ছোবড়া

নিজস্ব প্রতিবেদক
  ১৭ জুন ২০২৫, ১২:৫৮

নারকেলের ছোবড়া, কাপড়ের টুকরা, তুলা আর সুতা—দেখতে খুব সাধারণ, অথচ এই উপকরণগুলো দিয়েই বাগেরহাটের নারীরা তৈরি করছেন এমন সব পণ্য, যেগুলোর চাহিদা এখন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে পৌঁছে গেছে ইউরোপের বাজারে।

পাখির বাসা, কুকুর-বিড়ালের ঘরবাড়ি, খেলনা, স্লিপার, ফুলের টব কিংবা সফট টয়—সবই তৈরি হচ্ছে নারীদের নিপুণ হাতে। এরপর তা রপ্তানি হচ্ছে বেলজিয়াম, জার্মানি ও গ্রিসসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে।

স্থানীয় উদ্যোক্তা রোজী আহমেদের গড়া কারখানা ‘মার্সাস অর্গানিক প্রোডাক্ট’ এখন রপ্তানির পাশাপাশি নারী কর্মসংস্থানের এক অনন্য উদাহরণ হয়ে উঠেছে।

বাগেরহাট শহরের বাসাবাটি এলাকায় নিজ বাড়িতে গড়ে তোলা এই কারখানাটিতে এখন প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০ জন নারী কাজ করছেন। তাদের মধ্যে কেউ গৃহবধূ, কেউ কলেজপড়ুয়া। কেউ নারকেলের ছোবড়া কেটে ছাঁচ বানাচ্ছেন, কেউ কাপড়ের সেলাই করছেন, কেউবা খেলনার ভেতর তুলা ভরছেন। নিপুণ হাতে তারা পণ্যগুলো তৈরি করছেন পরিপূর্ণ রপ্তানিযোগ্য রূপে।

এই কারখানায় সরজমিনে গেলে দেখা যায়, তিনতলা ভবনের নিচতলা ও পাশের একটি একতলা ভবনের পাশাপাশি একটি টিনশেড ঘরজুড়ে চলছে নানা ধরনের পণ্য তৈরির কাজ। প্রায় ২৫ থেকে ৩০ জন নারী সেখানে কাজে ব্যস্ত। তৃতীয় তলায় চলছে পাখির বাসা তৈরির কাজ, একতলা ভবনে তৈরি হচ্ছে স্লিপার ও অন্যান্য সামগ্রী। প্রতিটি পণ্যের নানা ধাপ—কাটিং, সেলাই, রঙ করা, গুছিয়ে প্যাকিং—সবই হচ্ছে নারীদের হাতে। নিজ হাতে তৈরি এসব পণ্য বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে জেনে কর্মীদের চোখেমুখেও ঝলমল করে গর্ব।

রোজী আহমেদ জানান, ২০১৯ সালে প্রথম তিনি নারকেলের ছোবড়া দিয়ে কোকোপোল, মালচিং ম্যাট, হ্যাংগ্রিড বাস্কেট ও ফুলের টব তৈরি করে দেশে বিক্রি শুরু করেন। ২০২০ সালের করোনা পরিস্থিতিতে কর্মহীন নারীদের কথা ভেবে তিনি বাড়িতেই পণ্য তৈরির উদ্যোগ নেন। শুরু করেন মাত্র ১০ থেকে ১২ জন নারীকে নিয়ে। প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের দিয়েই তৈরি করাতে থাকেন পাখির বাসাসহ নানা সামগ্রী।

একপর্যায়ে একটি বেসরকারি সংস্থা থেকে আসে এক হাজার পিস পাখির বাসা তৈরির অর্ডার। তিনি নিজেই একটি নতুন মডেল তৈরি করেন, যা অর্ডারদাতার কাছে বেশি পছন্দ হয়। এরপর থেকে ধীরে ধীরে উৎপাদনের পরিধি বাড়তে থাকে। প্রশিক্ষিত নারী কর্মীদের সংখ্যা বাড়ে, তৈরি হতে থাকে একের পর এক নতুন পণ্য।

রোজী জানান, তার কারখানায় বর্তমানে নারকেলের ছোবড়া দিয়ে তৈরি হচ্ছে ১৩ ধরনের পাখির বাসা, ফুলের বাস্কেট, কোকোপোল (লতাজাতীয় গাছের জন্য কাঠি), থালা-বাসন মাজার ঝুড়ি, বিড়ালের ঘর, দোলনা, ব্যাগ, খেলনা, চার ধরনের বিছানা, ড্রেজ, কুকুরের খেলনা, কাপড় আর ছোবড়া দিয়ে তৈরি স্লিপার, মালচিং ম্যাট, ইউন্টার শিট, সফট টয়, কাঠের টুল, বেবি ভাউচারসহ প্রায় ৪০ ধরনের পণ্য।

উৎপাদনে ব্যবহৃত উপকরণও পরিবেশবান্ধব—বাঁশ, কাঠ, তুলা, সুতা, রঙসহ প্রয়োজনীয় অন্যান্য সামগ্রী।

রোজী জানান, এসব পণ্যের প্রথম চালান ২০২২ সালে বায়ারের মাধ্যমে বেলজিয়ামে পাঠানো হয়। ২০২৩ সালে সফট টয়, স্লিপার, হেয়ার ব্যান্ড ও কুকুর-বিড়ালের খেলনা রপ্তানি হয় গ্রিসে। এরপর ২০২৪ সালে জার্মানিতে পাঠানো হয় দুই হাজার পিস পাখির বাসা। চলতি বছরের মে মাসে গ্রিসে গেছে ১১ হাজার জোড়া স্লিপার। গ্রিসের আরও একটি অর্ডারের জন্য বর্তমানে চলছে ৬০ হাজার জোড়া স্লিপার তৈরির কাজ।

ইতোমধ্যে চারটি দেশে প্রায় কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি হয়েছে বলে জানান রোজী আহমেদ। দেশীয় বাজার মিলিয়ে তার কারখানায় উৎপাদিত পণ্যের মোট বিক্রি প্রায় পাঁচ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।

রপ্তানি-প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কাঁচামাল। রোজী বলেন, ‘নারকেলের ছোবড়া এখন সহজলভ্য নয়। একসময় বাগেরহাটে প্রচুর নারকেল হলেও এখন উৎপাদন কমেছে। তাই পাশের দেশ ভারত থেকে আমদানি করতে হয়।’

এই কারখানা আগামীতে আরও বড় পরিসরে করার পরিকল্পনা রয়েছে রোজী আহমেদের। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ও আর্থিক সহযোগিতা পেলে কারখানার সম্প্রসারণ করতে চান। কারখানা বড় হলে অনেক সংখ্যক নারীর কর্মসংস্থান হবে এবং তার কারখানায় উৎপাদিত পণ্য বিদেশে রপ্তানির ফলে দেশও বৈদেশিক পাবে বলে জানান তিনি।

উদ্যোক্তা রোজীর এই সফলতায় তার পরিবারেরও রয়েছে বড় অবদান। তিনি বলেন, পরিবারের সদস্যরা তাকে নানাভাবে সহযোগিতা করছেন। তাদের যৌথ পরিবারের আরেকটি প্রতিষ্ঠানে কাঠ দিয়ে পরিবেশবান্ধব ঘর তৈরি করা হচ্ছে। সেই ঘরের বেড়া, জানালা, দরজা এমনকি ছাদও কাঠের। এসব কাঠের ঘরও রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপে।

এই কারখানায় কর্মরত অন্তি ঘোষ, বাগেরহাট সরকারি পিসি কলেজের অনার্সের ছাত্রী। পড়ালেখার পাশাপাশি পাখির বাসা তৈরির কাজ করেন। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন কাজ করে গড়ে ৪০০ টাকা পাই। এই টাকা পড়াশোনা ও সংসারে খরচ হয়।’

স্লিপার তৈরিতে যুক্ত জেনি আক্তার জানান, প্রতিদিন ২০০ জোড়া সোলের ওপর মেশিনে ভ্যাম্প সেলাই করে জোড়া লাগান তিনি। তার দৈনিক আয় ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা। এই আয়ে তাদের সংসার চলে ভালোভাবেই।

৬০ বছর বয়সী সাবিত্রী ঘোষ বলেন, ‘স্বামী মারা যাওয়ার পর চার বছর ধরে এখানে কাজ করছি। যা আয় হয়, তা দিয়েই সংসার চলছে।’

আরও কয়েকজন কর্মী—খুশি আক্তার, মলি বিশ্বাস, পপি আক্তার ও পলি সাহা জানান, কারখানাটি পুরোপুরি নারীবান্ধব। তারা কেউ পাখির বাসা, কেউ স্লিপার, কেউ সফট টয় বা পোষা প্রাণীর খেলনা বানাচ্ছেন। সবাই কর্মপরিবেশ ও নিজেদের কাজ নিয়ে সন্তুষ্ট।

বাগেরহাট বিসিক শিল্পনগরীর কর্মকর্তা মো. শরীফ সরদার বলেন, ‘রোজী আহমেদ একজন সফল নারী উদ্যোক্তা। তার কারখানার পণ্য এখন বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। এর ফলে স্থানীয় নারীদেরও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে।’

তিনি আরও জানান, রোজী চাইলে বিসিকের পক্ষ থেকে তাকে স্বল্প পরিসরে ঋণ দেওয়া হবে। যদি বড় ঋণের প্রয়োজন হয়, তাহলে ব্যাংকের সঙ্গে সমন্বয় করে দেওয়া হবে। কোনো কারিগরি সহায়তা, নকশা বা প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হলেও তা দিতে প্রস্তুত বিসিক। এমনকি বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি আনতে চাইলে তাতেও সহযোগিতা করা হবে।

নারীর হাতে তৈরি এ শিল্পপ্রতিষ্ঠান শুধু একটি উদ্যোগ নয়, বরং একটি অনুপ্রেরণা—যা দেখিয়ে দিচ্ছে, সামান্য উপকরণ দিয়েও বৃহৎ সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেওয়া যায়, যদি পাশে থাকে সাহস, দক্ষতা ও সহমর্মিতার সঠিক মিশ্রণ।

মন্তব্য করুন