রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫, ২২ আষাঢ় ১৪৩২

মব সন্ত্রাস ভয়াবহ পর্যায়ে, সরকারের হুশিয়ারিতে কাজ হচ্ছে না

প্রবাহ বাংলা নিউজ
  ০৬ জুলাই ২০২৫, ০৫:২২
ছবি- সংগৃহিত।

বাংলাদেশে মব সন্ত্রাস বা গণপিটুনির ঘটনা ভয়াবহভাবে বেড়ে চলেছে। বিশেষ করে, গত ১০ মাসে দেশে মব সন্ত্রাসের ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। ৩ জুলাই বৃহস্পতিবার কুমিল্লার মুরাদনগরে এক মা, ছেলে ও মেয়েকে চুরির অভিযোগে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
ঢাকায় আল আমিন, গাজীপুরে হৃদয় নামের এক যুবক, লালমনিরহাটে এক সেলুন কর্মী এবং সিরাজগঞ্জে এক মানসিক প্রতিবন্ধীসহ গত ১ সপ্তাহে অন্তত ছয়জন মানুষ মব সন্ত্রাসের শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন।
মব সন্ত্রাসের ঘটনাগুলো সম্প্রতি  এতটাই নিয়মিত হয়ে দাঁড়িয়েছে যে অনেক সময় পুলিশের উপস্থিতিতেও এসব ঘটনা ঘটছে।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে গত জুন পর্যন্ত ২৫৩টি মব সন্ত্রাসে নিহত হয়েছেন ১৬৩ জন, আহত হয়েছেন ৩১২ জন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আশ্বাস সত্ত্বেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, রাজনৈতিক প্রভাব, বিচারহীনতা ও আইনের শাসনের অভাবে সাধারণ মানুষ নিজেরাই আইন হাতে তুলে নিচ্ছে। সরকারের উপদেষ্টা, মানবাধিকার কর্মী, রাজনৈতিক দল ও পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা একে অপরকে দায়ী করলেও কার্যকর ব্যবস্থা এখনো চোখে পড়ছে না।
সংগঠনগুলোর মতে, মব সন্ত্রাসের ঘটনায় পুলিশের ব্যবস্থা নিতে দেরি করা বা হস্তক্ষেপে নিরব থাকার মানসিকতার কারণে এসব ঘটনার প্রতি সহানুভূতির বার্তাই দিচ্ছে।
এমন অনেক ঘটনায় দেখা গেছে, সহিংসতার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পরে পুলিশ সক্রিয় হয়েছে। জনতা তাণ্ডব চালিয়ে আইন নিজের হাতে তুলছে। আর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখেছে। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদার ওপর সাম্প্রতিক হামলার ঘটনায় পুলিশের নীরব ভূমিকার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। 
গত ১০ মাসে মব জাস্টিসের নামে ব্যক্তির ওপর হামলা, অফিস ও ঘরবাড়ি লুটপাট, ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা, মাজার, আখড়া ভাঙা, এমনকি নারীদের ফুটবল ম্যাচ পর্যন্ত বন্ধ করার ঘটনা ঘটেছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত মব সহিংসতায় অন্তত ১৭৪ জন নিহত হয়েছে।
মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন জানিয়েছে, 'মব সন্ত্রাসের মতো ভয়াবহ ঘটনার পরও আমরা সরকারের পক্ষ থেকে এমন কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ দেখতে পাচ্ছি না, যা মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে একটি শক্ত বার্তা দিতে পারে।'
সম্প্রতি এক বিবৃতিতে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর পক্ষ  থেকে বলা হয়, গত বছরের গণঅভ্যুত্থানের পর দেশজুড়ে যে মব সন্ত্রাসের ঢেউ শুরু হয়েছিল, তা এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
সাবেক সিইসি নুরুল হুদার ওপর হামলার ঘটনার পর সচিবালয়ে সাংবাদিকগণ মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কত জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'ঠিক কতজন তা আমি জানি না… তবে অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।'
সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকার এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে জানিয়েছে, গত বছরের আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে দেশজুড়ে ৭০টিরও বেশি মাজার ও আখড়ায় হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ বা লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে।
গত এক দশকের মধ্যে গত ১০ মাসে মব সহিংসতায় সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের ২৩ জুন পর্যন্ত অন্তত ১৭৯ জন মব হামলায় নিহত হয়েছেন।
গত ১০ মাসে মাসে গড়ে ১৭ দশমিক ৯ জন মব হত্যার শিকার হয়েছেন, যা গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০১৫ সালে মাসিক গড় ছিল ১১ দশমিক ২৫।
বছরভিত্তিক মব হত্যার সংখ্যা—২০১৬ সালে ৫১ জন, ২০১৭ সালে ৫০ জন, ২০১৮ সালে ৩৯ জন, ২০১৯ সালে ৬৫ জন, ২০২০ সালে ৩৫ জন, ২০২১ সালে ২৮ জন, ২০২২ সালে ৩৬ জন, ২০২৩ সালে ৫১ জন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য বলছে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত মব হামলায় ৩২ জন নিহত হয়েছেন। গত বছরের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত অন্তত ৯৬ জন মব হামলায় নিহত হয়েছেন।
তবে এ বছর এখন পর্যন্ত অন্তত ৮৩ জন মব হামলায় মারা গেছেন।
মব সন্ত্রাস রোধে সরকারের পক্ষ থেকে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ আসলেও বাস্তবে তা কোন কাজে আসছে না।

মন্তব্য করুন